একজন ডা. বতুল ও সৌদি প্রবাসী শ্রমিকদের করোনাকাল

|| সাগর চৌধুরী, সৌদি আরব থেকে ||

ফোনটা ধরতেই ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠলো, ডাক্তার আপা বলছেন ? হ্যাঁ, বলছি। কণ্ঠ থেকে কথা বের হচ্ছেনা। বুঝলাম শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বলেন আপনার জন্যে কি করতে পারি ? আপা আমার করোনা পজিটিভ। বলেই কাঁদতে শুরু করলো। ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম, কি বলবো !

আচ্ছা, কাঁদছেন কেন ? পজিটিভ হয়েছে তো কি হয়েছে ? ভাল হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। ক’দিন একটু কষ্ট হবে, তারপর সুস্থ হয়ে যাবেন। সে কেঁদেই যাচ্ছে, কথা বলতে পারছে না।

এই আলাপন সৌদি প্রবাসী শ্রমিক মিনহাজের সঙ্গে ডা. বতুল রহমানের।

গত রাতেই রিপোর্ট পেয়েছে মিনহাজ। করোনা পজিটিভ‍! রুমমেটরা সকালের মধ্যে তাকে রুম থেকে চলে যেতে বলেছে। এখন সে কোথায় যাবে ? যাবার কোন জায়গা নেই। সে ভাবতেই পারছেনা, পাঁচ বছর ধরে যাদের সাথে এক হয়েছিল, এক সাথে খাওয়া-দাওয়া করেছে, তারাই আজ এত রূঢ় ব্যবহার করছে। রুম থেকে বের করে দিচ্ছে !

অনেকক্ষণ কথা বলে মিনহাজকে আশ্বস্ত করেন ডা. বতুল।

আরেক রোগী এমদাদ। দু’দিন ধরে জ্বর, কাশি। তার কোম্পানির লোক জানতে পেরেই রিয়াদ শহর থেকে দূরে একটা জায়গায় একরুমে রেখে এসেছে তাকে। যেখানে, খাবার বা পানির কোন ব্যবস্থাই নেই। এখন কি খাবে ? আর চিকিৎসা? কোন উত্তর নেই। ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে বেচারা।

এক রুমে দুইজন একই সাথে অসুস্থ। অন্যরা রুম থেকে সরে গেছে। হট নম্বরে কল করেন করোনা টেস্ট এর জন্য। দু’দিন কেটে গেছে। অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। এ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে পুলিশকে কল দিয়ে একজনকে হাসপাতালে নিতে পারলেও ভর্তি করার পাঁচ ঘণ্টা পরেই মারা যায়। আরেকজন পরের দিন সকালে মারা যায় রুমের মধ্যেই। কতটা কষ্ট সহ্য করে মারা গেল, কেউ তা জানতেও পারলো না।

কাজে যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই কাশি বেড়ে যায় খালেকের। ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছিলনা। এক পর্যায়ে রাস্তার মধ্যেই মারা যায় সে। কেউ এগিয়ে আসেনি।

আসলামের করোনা পজিটিভ। তাকে রাখা হয়েছে একটা ভিলায় কোয়ারেনটাইনে, যেখানে আরও সব করোনা রোগী। শুরুতে কোনই সমস্যা ছিলনা। সাত দিন পর তার জ্বর, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। যেখানে তাকে রাখা হয়েছে, সেখানে শুধু দারোয়ান ছাড়া কেউ নেই। খাবার ওখান থেকে দিলেও, ডাক্তার, ওষুধের কোন ব্যবস্থা নেই। তার শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলেছে।

ডা. বতুলের দেখা এমন মিনহাজ, এমদাদ, খালেক হাজারে হাজার। এমন অসহায়ত্বে অভিজ্ঞতার নজির বাড়ছেই। বিদেশের মাটিতে নিঃস্ব, জরাজীর্ণ জীবন-যাপন করছে এরা। অনেকেই বেতন পাচ্ছে না। এদের নেই কোন চিকিৎসা। নেই থাকা খাওয়ার তেমন বন্দোবস্ত। নেই দূতাবাস থেকে কোন নির্দিষ্ট নির্দেশনা। করোনা পরীক্ষার অনেক চেষ্টা করেও পরীক্ষা করাতে পারছে না অনেকেই।

শ্বাসকষ্টের রোগী হাসপাতালে যেতে পারছে না। গাড়ি নেই। প্রাইভেট গাড়ি হাঁচি কাশি রোগীকে নিচ্ছে না। হাসপাতালে গেলেও ভর্তি হতে পারছে না। অঘোরে প্রাণ যাচ্ছে।

ডা. বতুলের মতে, বাংলাদেশীদের মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ, হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে যে বেতন মেলে তাতে পুষ্টিকর খাবারতো দূরে থাক কোনভাবে উদোরপূর্তি হয় আরকি। এভাবে খেয়ে না খেয়ে বেতনের প্রায় পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দিতে হয়। সেখানে বাবা-মা ভাই-বোনের ভরণপোষন। সেইসঙ্গে ধারদেনা শোধ সবমিলিয়ে বেতনের বেশীরভাগই চলে যায়। স্বাস্থ্যসুরক্ষা সেতো শূন্যের কোঠায়!

এখানে এরা আত্মীয়-পরিজনহীন পরিবেশে একটু অসুস্থ হলেই অস্থির হয়ে পড়ে। আর করোনাকালে অসুস্থতা ওদেরকে নিমেষে অস্থির আর অনিশ্চিত করে তোলে।

করোনার এই কালে একটু সর্দি-কাশি-জ্বর হলেই রুমের অন্যরা সরে যেতে বলে। কিংবা আলাদা করে দেয়। একা হয়ে মরার আগেই মনে মনে মরে যায় এরা। করোনা আক্রান্ত সন্দেহে কেউ কাছে আসবে না।

যখন একটা মানুষ জানতে পারে, সে করোনা আক্রান্ত, সংগে সংগে সে বুঝে নেয় তার জন্যে কি করুণ মৃত্যু অপেক্ষা করছে ! মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। অসুস্থতায় যেখানে নড়তে পারেনা, সেখানে খাওয়াটাও তার নিজেকে তৈরি করে খেতে হয়। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেবার কেউ থাকেনা। বাথ রুমে যাবার শক্তি নেই। ঘরের মধ্যে মরে থাকলেও দেখার কেউ নেই। অথচ এই রোগীদের সাথে একটু ভালভাবে কথা বললে, একটু আশার বাণী শোনালে, একটু সাহস যোগালে ওরা অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠে।

সৌদিআরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে কিছু চিকিৎসক এই সব রোগীদের চিকিৎসা দেয়া শুরু করেছেন গত দুইমাস ধরে। তাতে এরা জানতে পারছেন কি করতে হবে, কি মেনে চলতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে পারছেন।

হয়ত আরও আগে থেকে দূতাবাসের এই চিকিৎসাসহায়তা কার্যক্রম চালু করলে ভাল হতো জানিয়ে ডা. বতুল বলেন, এমন দুর্যোগে দূতাবাসের এই উদ্যোগ করোনা সন্দেহ ও আক্রান্ত রোগীদেরকে চিকিৎসা সেবা, পরামর্শ, ও তাদের মনোবল বাড়াতে অনেকটাই কাজে আসছে।

তবে এদের সাথে কথা বলে মনের সাহস বাড়িয়ে দিতে, এই ভীতিকর পরিবেশে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ আশার বাণী শোনালে যে কতটা কাজ হয়, তা রোগীদের পাশে না এলে কেউ অনুধাবণ করতে পারবে না বলেও জানান ডা. বতুল রহমান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন