উপকূল দিবস এখন সময়ের দাবি

সম্প্রতি ১২ নভেম্বর ২০২০ উপকূলজুড়ে এ দাবি পূর্বের ন্যায় এবারও উচ্চারিত হয়েছে। উপকূল ফাউন্ডেশন আয়োজনে রাজধানী ঢাকাসহ ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী

|| এম. আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী ||

উপকূলের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন প্রজন্মের কাছে ১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’ চাই-এমন দাবি আজ চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। টেকনাফ থেকে শ্যামনগর পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার তটরেখাজুড়ে এখন ‘উপকূল দিবস চাই’ বলে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সম্প্রতি ১২ নভেম্বর ২০২০ উপকূলজুড়ে এ দাবি পূর্বের ন্যায় এবারও উচ্চারিত হয়েছে। উপকূল ফাউন্ডেশন আয়োজনে রাজধানী ঢাকাসহ ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে ‘উপকূল দিবস’ এর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। প্রাথমিকভাবে ২০১৫ সালে উপকূল ফাউন্ডেশন ‘উপকূল দিবস’ এর দাবি তুলে।

পরবর্তী ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে উপকূল ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্র পরিসরে ‘উপকূল দিবস’ পালন এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৯ সালে ১২ নভেম্বর বৃহৎ পরিসরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন শেষে গোলটেবিল আলোচনায় উপকূল ফাউন্ডেশনের দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ ও ‘উপকূল উন্নয়ন বোর্ড’ কেবিনেটে উপস্থাপনে আশ^স্ত করেন। এবার একই দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে “ভয়াল ১২ নভেম্বর: উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় টেকসই বেড়িবাাঁধ” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ‘উপকূল দিবস’ দাুিবও প্রধান্য পায়।

এবার দেশের শতাধিক স্থানে উপকূল ফাউন্ডেশনসহ অন্যান্য সংগঠন ‘উপকূল দিবস’ এর কর্মসূচি পালন করেছে। উপকূল ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি অন্যান সংগঠনও দাবির পক্ষে সোচ্চার হয়ে আওয়াজ তোলে। এর মধ্যে আছে ইয়ূথ পাওয়ার ইন বাংলাদেশ, কোস্টাল জার্নালিজম ফোরাম, গণমাধ্যম কর্মীদের সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, কিশোর-তরুণদের ফোরাম ইত্যাদি। মহান স্বাধীনতার পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও ভয়াল ১২ নভেম্বর দুর্যোগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও মেলেনি। উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বাস করেন। ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নামই উপকূল। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদী-ভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধশত বছরে সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। ১২ নভেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালন করার দাবি বাস্তবায়ন করবে।

কেন ১২ নভেম্বর উপকূল দিবস হবে? ভয়াল ১২ নভেম্বর উপকূল জীবন ইতিহাসের এক ভয়াবহ কাল রাত। ১৯৭০ সালের এ দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সাগর, নদী, খাল-বিলে ভেসেছিল অসংখ্য লাশ আর ১ কোটি মৃত গবাদি পশু। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরাণ জনপদে পরিণত হয়। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী গণকবর ও শাসকহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল প্রিয় (পূর্ব পাকিস্তান) স্বদেশ। মানুষ বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ রেখে অঘোষিত শাসকে ত্রাণ নিয়ে ছুটে আসেন উপকূল থেকে উপকূলে। দাঁড়ান বিপদগ্রস্থ অসহায় মানুষের পাশে।

আশার-আলোর মশাল পেলো উপকূলের মানুষ, অভিভাবক পেল উপকূলের মানুষ। ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হলো; শুরু হলো নতুন করে, নতুন স্বপ্নে জীবন বাঁচার লড়াই। সেই দিন বঙ্গবন্ধুর আহবানেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁরই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপকূল বান্ধব একজন প্রধানমন্ত্রী; আমরা দেখেছি তিনি সরকারি প্রটোকল ভেঙ্গে সমুদ্রের নোনাজল পায়ে মাখিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন কক্সবাজার উপকূল। উপকূলের সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা এবং উপকূলের মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি আদায়ে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। তাই আমরা উপকূল ফাউন্ডেশন ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ ও ‘বিশ^ উপকূল দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি চাই।

’৫২ এর ভাষা আন্দোলন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করলেও শেষে পেরেক ঢুকে দিয়ে ছিল এই ঘূর্ণিঝড়। ঐতিহাসিকভাবে ’৫২ আর ভয়াল ’৭০ বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু-শেষে অতপ্রতভাবে জড়িত। ’৫২ যেমন আমাদের ‘ভাষা দিবস’ ও পৃথিবীর মানুষ হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পেয়েছি; তেমন ’৭০ এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে ‘উপকূল দিবস’ ও পৃথিবীর মানুষ হিসেবে ‘বিশ^ উপকূল দিবস’ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ভৌগোলিক অবস্থান ও পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ হিসেবেও বাংলাদেশ দাবিদার। এছাড়াও জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভয়াল ’৭০ এর ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ থেকেও উপকূলের জন্য ১২ নভেম্বর দিনটি গুরুত্বপূর্ণ।

সার্বিক বিবেচনায় ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধশত বছরে বাস্তবায়ন হোক ১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’। কেন না, উপকূলের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ; উপকূলকে প্রাকৃতিক বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত রাখা; উপকূলের দিকে নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ; উপকূলের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা; উপকূলের সকল সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা সুগম করা; উপকূলের দিকে দেশি-বিদেশি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নজরে আনা; উপকূলের ইস্যুগুলো জাতির সামনে সহজে তুলে ধরাসহ ’৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সাইক্লোনে নিহতদের স্মরণ। ‘উপকূল দিবস’ হলে সকল বিষয়গুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ণ করা সম্ভব হবে। এখন সময় শুধু দাবি আদায়ের আর উদ্দ্যোগ গ্রহণের।

লেখক: পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন