সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে সম্পদগত ক্ষতি সাত হাজার কোটি টাকা
|| মীর আব্দুল আলীম ||
“একদিনে সড়কে ঝরলো ২২ প্রাণ”। ২৭শে ফেব্রুয়ারির দেশের সবক’টি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় সড়ক দুর্ঘটনার এ খবরটি স্থান পেয়েছে। এরমধ্যে সিলেটে দুই বাসের সংঘর্ষে ৮, বগুড়ায় ৬, ঝিনাইদহতে ৩, বরিশাল ও ময়মনসিংহে ২ জন করে এবং চট্টগ্রামে একজন প্রাণ হারায়। এমন মৃত্যুর সংবাদ আমরা প্রতিনিয়তই পাচ্ছি। আমাদের সড়ক আর নিরাপদ হলো না। দিনদিন আরও অনিরাপদ হচ্ছে।
এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়কে গড়ে ১০টি দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে গড়ে ১২ জনের মত মানুষ। ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের দেশে এমন মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক। সড়ক নিরাপদ করতে একের পর এক আইন হয়েছে কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি। প্রতিদিন সড়কে মূল্যবান প্রাণ যাচ্ছে। সাইফুর রহমান, মিশুক-মনিরদের জীবন যাচ্ছে, রাজীবের হাত যাচ্ছে, কারো পা যাচ্ছে, মাথা যাচ্ছে। রক্তাক্ত হচ্ছে সড়ক। থামছে না সড়কে মৃত্যু মিছিল।
আমরা বিশেষ দু’একজনের জন্য আহ্ উহ্ করি। প্রতিদিন কত খালিদ, কত হৃদয় পঙ্গু হচ্ছে, জীবন দিচ্ছে তার খোঁজ কি রাখি আমরা? চলতি মাসের (ফেব্রুয়ারি) ১১দিন দুবাইতে ছিলাম, চোখ বুজে রাস্তা
চলেছি, নিরাপদ মনে করেছি। দেশের সড়ক নিরাপদ নয় কেন? আমরা কেন মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে পারছি না? কেবল আলোচিত ঘটনায় মন্ত্রী, এমপিরা ছুটে যায়, স্বজন কিংবা লাশের পাশে। আমরা মায়া কান্না করি; লাভ কি তাতে?
এদেশে আইন হয় আইনের প্রয়োগ হয় না কখনো। দুঃখজনক হলেও সত্যি এদেশে আইন নিযন্ত্রণ করেন সড়ক পরিবহন নেতারা। আরও ক্ষোভের কথা হলো, এদেশের সড়ক পরিবহনের শীর্ষ নেতা (শাহজাহান খান) সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়ের মানুষ। সড়ক নিরাপদ করতে নয়া আইন হয়েছে। তা বাস্তবায়ন শুরু হয় ১লা নভেম্বর ২০১৯ থেকে। শুরুতে তর্জন গর্জন শুনেছি। ভালো লেগেছে। পরে দেখলাম শ্রমিক নেতাদের দেনদরবারে হঠাৎ থমকে গেছে সরকার ও প্রশাসনের আইন প্রয়োগের কার্যক্রম। সড়ক নিয়ে আন্দোলনে নামা নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন উল্টো শাহজাহান খানের হুমকির মুখে পড়েন। থমকে গেছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও। তাই রাস্তায় আগের চেয়ে বেপরোয়া চালক। যা হবার তাই হচ্ছে সড়কে। উচ্চ আদালত আনফিট গাড়ি সড়কে না চলতে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু আনফিট গাড়ি এখনও সড়কে চলছে। তবে আনফিট গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চললে সড়কে গাড়ি সংখ্যা কমে যায়। এতে জনগণের ভোগান্তি বাড়ে উল্লেখ করে সড়ক ও
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা বিকল্প ব্যবস্থার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করছি।’ এটা কিন্তু সরকারের উল্টো পথে হাঁটারই লক্ষণ। সরকার নমনীয় হলে কিংবা আইনের প্রয়োগ না হলে সড়কে মানুষ তো মরবেই।
উচ্চ আদালত আনফিট গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ না করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। জ্বালানি স্টেশনগুলোতে সাইনবোর্ডও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, ‘ফিটনেস ছাড়া জ্বালানি সরবরাহ করা হয় না।’ অথচ, সে নির্দেশও এখন অকার্যকর। এ প্রসঙ্গে সড়ক ও পরিবহনমন্ত্রী বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনায় বাস্তবতার নিরিখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তেল দেয়ার বিষয়টি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের। হাইকোর্ট যখন আদেশ দিয়েছেন, পেট্রল পাম্প তো জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, তারা এ আদেশ মানার প্রক্রিয়ায় কতটুকু এগিয়েছে, তা জানি না’। হাইকোর্ট যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আমরা দেখেছি সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেও হেলমেট না থাকলে তেল নয়, যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেটি কার্যকর হয়েছে। কাজেই আনফিট গাড়িতে তেল সরবরাহ না করার এ বিষয়টি মনে হয় জনস্বার্থে মেনে নেয়া দরকার এবং মেনে নিলে মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু সেটা কার্যকর হচ্ছে না এখনো। হয়তো হবে না কখনো। এদেশে হাইকোর্টের নির্দেশকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় তারা।
আমাদের কত কিছুর জন্যই তো আইন আছে, প্রয়োগ হয় ক’টা? এদেশে কঠোর খাদ্য আইন আছে, তবুও প্রায় সব খাবারেই বিষ মেশানো থাকে। নারীর প্রতি সহিংসতাবিরোধী আইন আছে, কিন্তু এদেশের নারীরা কতটা নিরাপদ। ধর্ষিত হয়ে, খুন হয়ে যাবার পর নুসরাতের মতো ক’টা ঘটনার বিচার হয় এদেশে? সড়ক আইন ছিলো আগেও, এখনও আছে। প্রয়োগ হয় কি? নয়া আইনের প্রয়োগ নিয়েও মনে প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি মারে। তবুও আশা করতে দোষ কোথায়? সড়কে সড়কে ফ্লাইওভার, মেট্রো রেল, স্বপ্নের পদ্মা সেতু সেবই তো দেখছি।
নতুন করে জানলাম শিশুরা নতুন বছর নতুন বইয়ের সাথে টাকা পাবে। বয়স্ক মানুষ, দরিদ্র মানুষ ভাতা পাচ্ছে। একদিন আমরা দেশের সকল নাগরিকরা হয়তো ভাতার আওতায় আসবো। ফ্রি চিকিৎসা পাব। এমন স্বপ্ন এখন দেখতে পারি। ভাবি সব কিছুইতো হচ্ছে। কিন্তু খুনের সড়ক কি আদৌ নিরাপদ হবে কখনো? আমাদের বিশ্বাস, সড়ক ঠিকই নিরাপদ হবে। কিছু কিছু ঘটনায় দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী নাড়া দিলে সব নড়ে চড়ে ওঠে। তিনি দৃষ্টি দিলে সব সহজে হয়ে যায়। এখানেও তিনি যদি নজর দেন, তাহলেই হয়তো সব ঠিক হতে পারে, নিরাপদ হতে পারে সড়ক। এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা হলো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত্যুদূতের মতো। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা যাবে কি? এমন সংশয় বরাবরই থেকে যায়। এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়াও কঠিন বাংলাদেশে। তাই প্রতিদিন গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বিভৎস ছবি, দেখতে পাই স্বজন হারানোদের আহাজারি। আমাদের সড়ক যেন এখন মরণফাঁদ। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন অকালে প্রাণ ঝরছে না, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বাতাস ভারি হয়ে উঠছে না। দেশে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে তাতে, নিরাপদ সড়ক বলে আর কিছু নেই। এ অবস্থায় আজকাল আর কেউ ঘর থেকে বের হলে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ফের ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের
মুখে পরে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনা
মারাত্মক হারে বেড়েছে। দুর্ঘটনার সাথে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এদেশে বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব ক’টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে।
এদেশে সড়ক দুর্ঘটনা স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নয়, তা হচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে। এই হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার কাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ নেই। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন মানুষ। প্রতি
বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে দায়িত্বশীলদের তরফে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ জন। সরকারি তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি যথাযথভাবে রেকর্ডভুক্ত হয় না।
পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ১৪০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬ এবং সামান্য আহত হয়েছে ১৫৭ জন। অন্য একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরো কয়েক হাজার মানুষ।
২০১৯ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশে। সবচেয়ে কম হার যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪
শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সামপ্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এই হার দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। অন্য এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম মূল কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন,
২. গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার
৩. অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন
৪. ট্রাফিক আইন না মানা
৫. সশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা
৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা এবং
৭. অরক্ষিত রেললাইন।
কথা হলো, যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয় তবে তা মেনে নেয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির নিরসন করতেই হবে। এভাবে চলতে
পারে না। এভাবে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না। পঙ্গুত্বের মতো দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ জীবন কাটাতে পারে না। কারণগুলো যেহেতু চিহ্নিত সেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দুরূহ হবে কেন?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট