|| সাইফুল ইসলাম ||
ইংরেজি Journal এবং Ism নিয়ে Journalism বা সাংবাদিকতার উদ্ভব। এর অর্থ কোনো কিছু প্রকাশ করা ও অনুশীলন করা বা চর্চা করা। এ হিসেবে কোনো কিছু জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য যে চর্চা বা অনুশীলন তাই হলো সাংবাদিকতা। আমাদের দেশে সাংবাদিকতার অংশ হচ্ছে সংবাদ সংস্থা, এজেন্সি, ব্যুরো, প্রচার মাধ্যম, মিডিয়া, সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, রিপোর্টার, প্রতিনিধি, সংবাদদাতা, কলমচি, কলামনিস্ট, ভাষ্যকার, প্রভৃতি পদ-পদবি।
বিশ্বের সংবাদপত্রের ইতিহাস ৩৯৭ বছরের। বিশ্বের প্রথম সংবাদপত্র ‘কোরান্টস’ প্রকাশিত হয় ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে থেকে। আর আমাদের এ উপমহাদেশে এর ইতিহাস ২৩৮ বছরের। এ অঞ্চল থেকে ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি।
এদেশে এমন একটি পেশা আছে যেখানে চাকরি আছে, পদ আছে, পদবিও আছে- কিন্তু বেতন নেই। কী এ পেশার নাম? এ প্রশ্ন করলে অনেকেই জবাব দিতে পারবেন না। এ পেশার নাম হচ্ছে গ্রামীণ সাংবাদিকতা বা মাঠ সাংবাদিকতা বা মফস্বল সাংবাদিতকা।
![](https://i0.wp.com/www.sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/05/1.-Saiful-Islam.jpg?resize=271%2C344&ssl=1)
বাংলাদেশে মফস্বল সাংবাদিকতা তথা আঞ্চলিক সাংবাদিতকার এক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। দেশ বিনির্মাণে এখনো সে প্রবাহ চলছেই। মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কুষ্টিয়ার কৃতী সন্তান কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সে সময় ব্রিটিশ শাসকদের নির্যাতনের কথা, গ্রাম-বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের কথা লিখতে থাকেন ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায়। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এক পয়সা মূল্যের এই পত্রিকাটিতে কাঙাল হরিনাথ অবিরাম নীলকর ও জমিদারদের নানা জুলুমের কথা প্রকাশ করতে থাকেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে যশোর ঝিকরগাছার মাগুরা গ্রামের শিশির কুমার ঘোষ নিজস্ব ছাপাখানায় দিনরাত শ্রম দিয়ে ‘অমৃত প্রবাহিনী ’ নামের পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই সময় ঐ পত্রিকায় নীল বিদ্রোহ নিয়ে অগ্নিঝরা লেখা প্রকাশ করতেন তিনি। যার ফলে অত্যাচারী নীলকরদের হৃদকম্পন শুরু হয়েছিল। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধুমকেতু’ নামের একটি সাময়িকী প্রকাশ করতেন। আর সে পত্রিকায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সাহিত্য কর্ম প্রকাশের পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রবাদিতা, হিংসা, ঘৃণার বিরুদ্ধে এবং ভালোবাসা ও মানবীয় মুক্তির পক্ষে তাঁর কলম চালাতেন।
ইদানিংকালে এসে আমরা অন্তরালের খবর খুজে ফেরা ‘পথ থেকে পথে’ ‘সংবাদ নেপথ্য’ ‘কানসোনার মুখ’ গ্রন্থের লেখক একুশে পদক পাওয়া চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনকে পাই।
প্রভাবশালী মিডিয়া হাউজ অথবা কিছু উন্নাসিক লদ্ধপ্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকের কাছে মফস্বল বা আঞ্চলিক পর্যায়ের সংবাদকর্মীরা যতই অচ্ছুৎ হন না কেন; সংবাদ মাধ্যম বা সাংবাদিকতার বিশেষায়িত রূপের শেকড়টি কিন্তু গাঁও-গেরামের আদি নিবাসেই প্রোথিত। কিন্তু মফস্বল সাংবাদিকদের ভাগ্য রাজধানীকেন্দ্রিক হর্তাকর্তাদের ইচ্ছের পেন্ডুলামেই দোল খাচ্ছে। সংবাদ রাজ্যের নাগরিক পিতারা গ্রাম্য অনার্য বা হরিজন সাংবাদিকদের সাথে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের সামন্ত প্রথাই চালিয়ে যাচ্ছেন।
গ্রাম-বাংলার পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে খবরের নানা উপাদান । প্রতিদিন ঘটছে বিচিত্র সব ঘটনা। একজন মফস্বল সাংবাদিক সেই তৃণমুল পর্যায় থেকে নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে খবর সংগ্রহ করে পত্রিকা অফিসে (ডেস্কে) পাঠান। তারপরও নিশ্চয়তা থাকে না সেই সংবাদটি ছাপা হবে কি না।
বর্তমানে মফস্বল সাংবাদিকদের কাজের পরিসর বেড়েছে। তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো বিট নেই। তাঁদের একাধারে ক্রাইম, রাজনীতি প্রশাসন, খেলাধুলা, ইত্যাদি সকল বিষয়ে রিপোর্ট পাঠাতে করতে হয়। কেবল সমাজে ভাল কিছু করবার নেশায় একজন মানুষ যখন মফস্বল সাংবাদিকতায় নাম লেখান সেই তাঁকে নিশ্চয় স্বপেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ, মানবিক, কঠোর পরিশ্রমী, সময়ানুবর্তী, সাহসী, কৌতুহলী, বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষিপ্র, প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন, দল নিরপেক্ষ, সৎ, ধৈর্যশীল, ভদ্র, সৌজন্যবোধ সম্পন্ন, রস ও সাহিত্যবোধ সম্পন্ন প্রভৃতি নানাগুনে গুনান্বিত হতে হয়।
কিন্তু সেই মানুষটিকেও সমাজের সব ভাল মানুষদের পাশাপাশি চোর, ডাকাত, মাস্তান, টাউট, বাটপার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, খুনি, খুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, দখলদার, বাজে পলিটিশিয়ান ও অবৈধ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে জীবন বাজী রেখে লড়াই করতে হয়। তাঁর বিনিময়ে তাঁর কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন কী তিনি পান?
বর্তমানে হলুদ সাংবাদিকতা মফস্বল সাংবাদিকতার আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনেকের মধ্যেই সাংবাদিক হওয়ার একটা আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। তাদের কেউ ছাত্র বা বেকার যুবক অথবা টাউট শ্রেণির কেউ। যাদের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। উন্নত ভাষা জ্ঞান নেই। পেশার মর্যাদার প্রতি নেই শ্রদ্ধা। নিজেকে জাহির করা অথবা অনৈতিক কোন ধান্ধা করার অসৎ উদ্দেশ্যে সাংবাদিক হতে চাচ্ছেন তাঁরা।
কোন কোন পত্রিকা কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট যাচাই-বাছাই না করেই অনেক ক্ষেত্রে এধরণের ব্যক্তিদের হাতে পরিচয়পত্র নামক হাতিয়ার তুলে দেন। এতে কিছু অসৎ ব্যক্তিও ঢুকে পড়ছে এ পেশায়। ফলে এ পেশার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন বলেছেন, “এখন পঞ্চম শ্রেণি আর অষ্টম শ্রেণি পাস করে সাংবাদিকতায় আসছে। পানের দোকানদার, চায়ের দোকানিও এখন সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছে। যে ফেসবুক চালায় সেও মোটর সাইকেলের সামনে প্রেস লাগিয়ে ঘুরছে। এই ভুয়া সাংবাদিকদের কারণে সাধারণ মানুষ যেমন জিম্মি, ঠিক তেমনি প্রকৃত সাংবাদিক ও তাঁদের মহান পেশার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। অতএব হলুদ সাংবাদিকতারোধে কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া আবশ্যক।”
চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন বলতেন, ৬৮হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’ অতএব, একজন মফস্বল সাংবাদিক সাংবাদিকতার কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্কের মাঝখানে সেতু হয়ে উঠতে পারেন। গ্রামীণ মানুষের শোক, সুখ আর দুঃখ-গাঁথা তাঁর কলমের শক্ত গাঁথুনিতে জায়গা করে নিতে পারে পত্রিকার প্রধানতম জায়গা। টেলিভিশনের গুরুত্বপূর্ণ টাইমস্পেস। আর দেশের সামগ্রিক সাংবাদিকতায় দেখা যাবে বিপুল বৈচিত্রময়তা। এজন্য মফস্বল সাংবাদিকদের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। সবশেষে একজন মফস্বল সাংবাদিক হিসেবে বলতে চাই, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “রূপনারানের কূলে উঠিলাম, জানিলাম- এ জগৎ স্বপ্নময়। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। সে কখনো করে না বঞ্চনা।”#
সাইফুল ইসলাম, প্রভাষক, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া