চালকলে জ্বালানিদক্ষতা সংযোজনে কমবে পরিবেশদূষণ বাড়বে উৎপাদন

|| নাফিজুর রহমান ||

বিশ্বের চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চার নম্বর। সাম্প্রতিকসময়ে রাষ্ট্রের দিক থেকে কৃষিবান্ধব নীতি ও কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়ায় বাড়ছে ধান ও চালের উৎপাদন। ইতোমধ্যে ধান উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে সারের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ কমানো হয়েছে। উৎপাদিত চাল সরকারীভাবে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা হচ্ছে। এছাড়া দেশের প্রায় ১৭ হাজার নিবন্ধিত চালকলসহ প্রায় ৫০ হাজার চালকলমালিক বা মিলারের কাছ থেকেও চাল সংগ্রহ করছে সরকার। ফলে মিলাররা তাদের উৎপাদিত চালের একটি বড় অংশ বিক্রির নিশ্চয়তা পাচ্ছে। 

চালকলে উৎপাদিত চালের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ সিদ্ধ করে উৎপাদন করা হয়, যার বেশির ভাগই দেশের প্রায় পঞ্চাশ হাজার খুদ্র ও মাঝারি আকারের চালকল ও চাতালে প্রক্রিয়াজাত হয়। এই সিদ্ধ প্রক্রিয়ায় জ্বালানির অধিক মাত্রায় ব্যবহার ও পরিবেশ দুষণ হয়ে থাকে। বর্তমানে এসব চালের ৮০ ভাগ জ্বালানিঅদক্ষ বয়লারের মাধ্যমে সিদ্ধ করা হয়, যার জ্বালানিদক্ষতা মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ।

উপরন্ত এসকল বয়লার থেকে নির্গত কার্বণযুক্ত ধোঁয়া পরিবেশ দুষিত করে এবং জনস্বাস্থের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। চিমনির মাধ্যমে নির্গত কালোধোঁয়া আশপাশের জমির কৃষি উৎপাদনে বিরুপ প্রভাব ফেলছে। দেশের প্রায় সকল জেলায় এ ধরনের চাল উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরন চাতাল রয়েছে। তবে দেশের উত্তর ও দক্ষিন পশ্চিমের জেলাগুলোতে অধিকসংখ্যক চাতাল অবস্থিত।

চাতালের উচ্ছিষ্ট ছাই ব্যবস্থাপনা আরো বড় একটি সমস্যা। কিছু কিছু চাতালমালিক কৃষিজমিতে গর্ত করে অথবা রাস্তার ধারে, নদী বা খালে এসব ছাই ফেলে দেওয়ায় কৃষি ও জল-জীববৈচিত্রের ওপর কুপ্রভাব ফেলছে। এসব ছাই ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন করা সম্ভব। যার উৎপাদন ব্যয় তুলনামুলক কম এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নতুন বানিজ্যিক সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

অন্যদিকে এসকল চাতালে ব্যবহৃত অনুন্নত প্রযুক্তি ও নিম্নমানের স্টিল সিটে তৈরি বয়লার বিস্ফোরণে প্রতি বছর অনেক চাতাল শ্রমিক আহত হয় এবং মারা যায়। অনুন্নত ও  পুরনো প্রযুক্তি নির্ভর চালকলের বেশীর ভাগের উৎপন্ন চাল নিম্নমানের এবং বাজারমূল্য কম হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রচুর চাল ভেঙ্গে ক্ষুদে পরিণত হয় যার বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন। উপরন্ত ধানের তুষ (Rice Husk) ও কুড়া (Rice Bran) আলাদাভাবে আহরণ করা সম্ভব হয় না।

আশারকথা, ইতোমধ্যে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) সাসটেইনেবল এনার্জি ফর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় জার্মান সাহায্য সংস্থা’র (GIZ) কারিগরী সহায়তায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালকলসমূহের জন্য জ্বালানিদক্ষ ও দুষনমুক্ত চাল উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে উন্নত বয়লার এবং হলার মেশিনের উপোযোগিতা বিষয়ক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

এই কার্যক্রমের অধীনে এপর্যন্ত ৬৮টি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবং উন্নত বয়লার ও চালকল প্রযুক্তির প্রসারে প্রায় ৫০ জন দক্ষ কারিগর তৈরি করা হয়েছে।

এসব উন্নত প্রযুক্তি দেশের প্রায় সকল ক্ষুদ্র ও মাঝারী আকারের চালকলে ব্যবহার করতে পারলে প্রচলিত চালকলের কর্মক্ষমতা ও জ্বালানিদক্ষতা বাড়বে। ধানসিদ্ধের জন্য ব্যবহৃত তুষের পরিমাণ কমবে ৫০ ভাগ। সিদ্ধ করতে সময় কম লাগবে। বয়লার বিস্ফোরনের ঝুঁকি থাকবে না। কালোধোঁয়া নির্গমন ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কমায় কার্বন নিঃসরণ কমবে যা পরিবেশ দূষণ কমাবে। উপরন্ত চালকলগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির হলার ব্যবহার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত চালের গুনগত মান বাড়বে।

এতে করে বর্তমানে চালকলগুলোে যে পরিমাণ ধান ব্যবহার করা হয় তা থেকেই অতিরিক্ত ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনসহ ধানের তুষ (Rice Husk) ও কুড়া (Rice Bran) আলাদাভাবে আহরণ করা সম্ভব হবে। উৎপাদিত কুড়া থেকে ক্ষতিকারক কোলস্টোরেলমুক্ত খাবার তেল উৎপাদন সম্ভব যা বর্তমানে আমাদের দেশসহ অন্য অনেক দেশেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

উল্লেখ্য, উন্নত চালকল থেকে আহরিত কুড়া থেকে বছরে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন খাবার তেল উৎপাদন সম্ভব। যা দেশের মোট খাবার তেলের চাহিদা পুরণের পাশাপাশি দেশের এই খাতকে আমদানিনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা যাবে।

উল্লেখ্য যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৪ সালে চালকল, চাল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সুগন্ধিচালের জন্য ক্ষুদ্র্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা পূনঃঅর্থায়ন কার্যক্রম ((SME Refinance Scheme) চালু করে। কিন্তু এ কার্যক্রমে জ্বালানিদক্ষতা অর্জন ও উন্নয়ন বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

একটি প্রচলিত চালকলকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে জ্বালানিদক্ষ বয়লার ও উন্নত হলার মেশিন দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে চাতাল ভেদে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয় হবে। যা চাতাল ও মিলমালিকদের পক্ষে এককালীন বিনিয়োগ করা সম্ভব না। যে সকল চালকল মালিক প্রচলিত পদ্ধতিতে চালকলের মাধ্যমে চাল উৎপাদন করে তাদেরকে সহজশর্তে ও স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে তাঁরা জ্বালানিদক্ষ বয়লার ও উন্নত হলার মেশিন স্থাপনে উৎসাহী হবে।

এক্ষেত্রে পরিবেশ দুষণ নিয়ন্ত্রনের বিষয়টি মাথায় রেখে তাদেরকে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট ফান্ডের আওতায় এনে দুষণমুক্ত চাল উৎপাদনকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। যা আমাদের ধান-চাল প্রক্রিয়াজাত খাতকে পরিবেশবান্ধব খাত হিসেবে সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে।

লেখক : স্থপতি, গবেষক এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানিদক্ষতা বিশেষজ্ঞ

nafizhbri@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন