|| অনলাইন প্রতিনিধি, হবিগঞ্জ ||
করোনাদুর্গতদের দেয় আড়াই হাজার টাকার রাষ্ট্রিয় নগদ সহায়তা কার্যক্রমেও চলছে নয়ছয়। উপকারভোগীদের তালিকা তৈরিতে বিস্তর অনিয়ম। নগদ এই সহায়তার তালিকাতে জায়গা পেয়েছে অন্য অনেক জায়গার মত হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার সাড়ে ৬ হাজার পরিবার। তবে তালিকায় একই মোবাইল নম্বর ভিন্ন নামে ব্যবহার হয়েছে সর্বোচ্চ ২শ বার। তালিকাতে নাম লিখিয়েছেন অনেক ধনী ও জনপ্রতিনিধির আত্মীয়-স্বজনও।
দুর্গতদের জন্য দেয় এই অর্থ নিয়েও এমন অনিয়ম আর দুর্নীতিতে আবারো সমালোচনায় পড়তে হলো সরকারসংশ্লিষ্টদের। তবে প্রকৃত দুর্গতরা আদৌ এই সহায়তা পাবেন কিনা তা নিয়ে জোরালো হচ্ছে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। রাষ্ট্র ও সমাজের সচেতন নাগরিক ও দুর্গতদের দাবি বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত এমন অনিয়ম দূর করতে পারলেই প্রকৃতরা পাবে রাষ্ট্রের এই সহায়তা।
করোনা দুর্যোগে লাখাই উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ৬ হাজার ৭২০টি পরিবার পাচ্ছে নগদ আড়াই হাজার টাকা করে রাষ্ট্রিয় অর্থ সহায়তা। এর মধ্যে লাখাই ইউনিয়নে ১ হাজার ১৯৪ জন, মোড়াকরি ১ হাজার ১১৩, মুড়িয়াউক ১ হাজার ১৭৬, বামৈ ১ হাজার ২৪৬, করাব ১ হাজার ৬ ও বুল্লা ইউনিয়নে রয়েছেন ৯৮৫ জন। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের কাছে খসড়া তালিকা জমা দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
তালিকা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মুড়িয়াউক ইউনিয়নে ৪টি মোবাইল নম্বর ব্যবহার হয়েছে ৩০৬ জনের নামের পাশে। আর এই নম্বরগুলো পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মলাইয়ের স্বজন ও ঘনিষ্টজনদের। এছাড়া তালিকায় যুক্ত হয়েছে অনেক ধনী ও জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজনের নাম। রয়েছেন স্বামী-স্ত্রীসহ একই পরিবারের একাধিক সদস্যও।
একটি ওয়ার্ডে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস না থাকলেও লেখা হয়েছে তাদের নাম। অসংখ্যবার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরগুলো হলো- ০১৯৪৪৬০৫১৯৩, ০১৭৪৪১৪৯২৩৪, ০১৭৮৬৩৭৪৩৯১ ও ০১৭৬৬৩৮০২৮৪। এছাড়া আরো ৩০টি নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে ১০ থেকে বারোজনের নামের পাশে।
শুধু মুড়িয়াউকই নয়, উপজেলার ৬টি ইউনিয়নেই এ ধরনের অনিয়ম হয়েছে এবং সর্বোচ্চ ২শ বার একেকটি মোবাইল নম্বর ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মচারী।
এ ব্যাপারে মুড়িয়াউক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মলাই জানান, অল্প সময়ের মধ্যে তালিকা তৈরির কারণে ভুল হয়েছে। অসংখ্যবার মোবাইল নম্বর ব্যবহারের ভুলটি করেছেন উপজেলা প্রশাসনের কম্পিউটার অপারেটররা। যেগুলো সংশোধনের কাজ চলছে। বুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মুক্তার হোসেন বেনুও জানান একই কথা। পুনরায় শুদ্ধ তালিকা তৈরিতে তিনি তার লোকজনকে নিয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা প্রশাসনের কম্পিউটার অপারেটররা জানান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা অসম্পন্ন খসড়া তালিকা দিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা তা সম্পন্ন করি। ভুলবশত একেকটি নম্বর অনেকবার ব্যবহার হয়েছে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি লাখাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজংয়ের সঙ্গে। মোবাইলে বারবার কল দিলেও তা রিসিভ করেননি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকার।
তবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুশফিউল আলম আজাদ বলেন, খসড়া তালিকা জমা দেওয়ার পর আমরা তাতে অনেক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছি। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নেই সমস্যা হয়েছে। একেকটি মোবাইল নম্বর রয়েছে অনেকবার। ইতোমধ্যে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে হালনাগাগাদ তালিকা জমা দেবেন।
অন্যদিকে হবিগঞ্জ সদর উপজেলাসহ ৯টি উপজেলার তালিকা তৈরিতেও এ ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতে ব্যাপক সংকটে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই রাষ্ট্র নগদ সহায়তার এই উদ্যোগ নিয়েছে। এ ধরনের অনিয়মের কারণে বঞ্চিত হবেন অনেক অসহায় মানুষ। গুরুত্বপূর্ণ এই কাজে অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এক উপকারভোগী বলেন, তালিকায় আমার নামটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে অনিয়মের কারণে পরবর্তী তালিকায় আমি থাকবো কিনা এনিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সাহায্য পেতে বিলম্ব অথবা একেবারেই না পেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, তালিকা এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করা হবে। একই মোবাইল নম্বরে একাধিক ব্যক্তির নাম থাকলে কেউই অর্থ সহায়তা পাবেন না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সহায়তা হস্তান্তর বন্ধ হয়ে যাবে। তালিকা চূড়ান্ত করে পাঠানোর পরও কোনো ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে ত্রুটি পাওয়া গেলে তা পুনরায় যাচাই হবে।
তিনি এও জানান, ইতোমধ্যেই হবিগঞ্জ থেকে ১শ জনের তালিকা পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৯ জন মোবাইলের মাধ্যমে অর্থ সহায়তা পেয়েছেন। এই তালিকায় তাদেরই নাম থাকবে যারা ইতোপূর্বে রাষ্ট্রের অন্য কোনো সহায়তাকর্মসূচির আওতায় ছিলেন না। সরকারি এ সহায়তা পাবে দেশের ৫০ লাখ পরিবার।