হাঁসেই হাসছে জামালগঞ্জের জামিনার সংসার

অভাবের তাড়নায় চোখে সরষে ফুল দেখতাম। ঋণের জ্বালায় কাজের সন্ধানে ছেলেমেয়েদের রেখে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। ঢাকায গিয়ে রোজ ৩০০ টাকা মুজুরিতে কাম করছি। তা দিয়ে আমার চলে না। তাই ছেলেমেয়েদের টানে বাড়িতে চলে আসি। গড়ে তুলি হাঁসের এই খামার। আল্লাহ তালার দয়ায় আমি বর্তমানে স্বাবলম্বী। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করে মানুষ করাই আমার স্বপ্ন।

|| ওয়ালী উল্লাহ সরকার, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে ||

দিন বদলের পালায় অনেক নারীই আজ খুঁজে নিচ্ছেন আয় রোজগারের পথ। পুরুষের পাশাপাশি নিজেরাও করছেন হয় চাকরি না হয় ব্যবসা। আবার অনেকে হচ্ছেন উদ্যোক্তা। এমনি একজন সামাজিক উদ্যোক্তা জামালগঞ্জের জামিনা।

অল্প শিক্ষিত জামিনার দুরাবস্থার শেষ ছিল না। এমনি পরিস্থিতিতে ঋণ নিয়ে শুরু করেন হাঁস পালন। হাঁসের হাসিতে সুখী করতে পেরেছেন পরিবার-পরিজনকে। সন্তানের লেখাপড়া করানোসহ মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে পৌঁছে নিয়ে গেছেন স্বাবলম্বি মানুষের কাতারে।

সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের দিনমজুর মহারাজ মিয়ার স্ত্রী জামিনা খাতুন। ২ ছেলে ৪ মেয়ে নিয়ে খুবই দূরাবস্থার মাঝে কাটাতে হয়েছে তাদের সংসার। ঋণের জ্বালায় জর্জড়িত হয়ে ছেলে-সন্তান রেখে ঢাকার কামরাঙ্গিরচরে চলে যান কাজের সন্ধানে।

স্বামী দিনমজুর থাকায় ২ ছেলে ৪ মেয়ে নিয়ে অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। ঢাকায় ৩ মাস থাকার পর ছেলেমেয়েদের টানে চলে আসেন গ্রামে। বাড়িতে এসে কিছুদিন অনাহারে থাকার পর একই গ্রামের এয়ার আলীর পরামর্শে “আমার বাড়ি আমার খামার” থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ ও কিছু ধারদেনা করে ২৮ হাজার টাকায় কেনেন ১ হাজার হাঁসের বাচ্চা।

হাঁস যখন ডিম দিতে শুরু করলো ঠিক তখনই ডিম বিক্রির টাকা আর পরের বছর একই সংস্থা থেকে নেওয়া ২০ হাজার টাকা ঋণ। সেইসাথে হাঁস বিক্রির জমানো টাকায় কেনেন আরও ২ হাজার ৫শ’টি হাঁস।

পরে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাড়িয়ে ফেলেন খামারের পরিসর। এর পরের বছরে “আমার বাড়ি আমার খামার” এর ঋণ পরিশোধ করে জামালগঞ্জ উপজেলার পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন অফিস থেকে নেন আরো ১ লাখ টাকা ঋণ।

এক বছরেই হাঁসের ডিম বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করে আবারও ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ২৫০ মণ ধান হাঁসের খাবারের জন্য কিনে রাখেন। জমিলা খাতুনের খামারে ছোট-বড় মিলিয়ে এখন হাঁসের সংখ্যা মোট ৪ হাজার। যার বাজার মূল্য প্রায় ১২ লাখ টাকা। হাঁসের দেওয়া ডিম বিক্রি করে প্রতি মাসে আসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।

হাঁস আর ডিম বিক্রির টাকা থেকে হাঁসের খাবার ও ২ জন শ্রমিকের বেতন দিয়ে মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ থাকে। খামারে প্রতিদিন হাঁসের খাবার বাবদ ৪ মণ ধান ও নারিশ পোল্ট্রি খাবারের দাম বাবদ খরচ ৪ হাজার টাকা।

খামারের আয় দিয়েই একটি চারচালা ঘর ও এক মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ১ ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন জামিনা। আরেক মেয়ে ৫ম শ্রেণি এবং আরেক ছেলে ২য় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। আরেক মেয়ে দর্জির কাজের প্রশিক্ষণ দিয়েও আয় করছে।

জামিনা খাতুন জানান, অভাবের তাড়নায় চোখে সরষে ফুল দেখতাম। ঋণের জ্বালায় কাজের সন্ধানে ছেলেমেয়েদের রেখে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। ঢাকায গিয়ে রোজ ৩০০ টাকা মুজুরিতে কাম করছি। তা দিয়ে আমার চলে না। তাই ছেলেমেয়েদের টানে বাড়িতে চলে আসি। গড়ে তুলি হাঁসের এই খামার। আল্লাহ তালার দয়ায় আমি বর্তমানে স্বাবলম্বী। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করে মানুষ করাই আমার স্বপ্ন।

জামিনার সাফল্য সম্পর্কে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকর্তা শিবেন্দ্র চন্দ্র পাল জানান, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচনের ঋণে জামিনার মতো আরও অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমরা এমন জামিনাদের সহায়তা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।

উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবুল কাসেম জানান, জামিনা খাতুন তার মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে হাঁসের খামারের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। উপজেলার প্রতিটি নারী এভাবে হাঁস-মোরগ ও গবাদি পশু পালন করে স্বাবলম্বী হতে পারেন। আমাদের পক্ষ থেকে জামিনার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন