|| ওয়ালী উল্লাহ সরকার, জামালগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) থেকে ||
এক ছেলে দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ করার এক মহান যুদ্ধে নেমেছে মনি বৈদ্য। জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের সাচনা গ্রামে বসবাস তার। স্বামী মারা গেছে ১১ বছর আগে। বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরেন মনি বৈদ্য। সাচনা বাজারে খোলে বসেন কবিতা লন্ড্রীর নামে কাপড় ইস্ত্রির দোকান। খেয়ে না খেয়ে কাটছে দিন। তবুও ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ করেননি। মনির স্বপ্ন অন্ধকার একদিন কাটবেই। আধাঁর ঘরে চাঁদের আলো আসবেই।
ক্যান্সার চিকিৎসায় সর্বস্য হারিয়ে নাফেরার দেশে চলে যান স্বামী পরেশ বৈদ্য। অন্ধকারে নেমে আসে মনি বৈদ্য (৪৫) এর চোখে মুখে। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে মাথা গোজার জায়গাটুকু নেই। অনাহারে অর্ধাহারে কাটে দিন। স্বাক্ষর জ্ঞান থাকলেও কোন স্কুলে যায়নি মনি। কিন্তু জীবন যুদ্ধে হারমানতে রাজি নন তিনি। ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলার শপথ নেন তিনি।
উপজেলার সাচনা বাজারে জগন্নাথ জিওর মন্দির রোডে গড়ে তুলেন কাপড় ইস্ত্রি করার লন্ড্রী। শান্তিগঞ্জ উপজেলার মৌ গাঁও গ্রামের পরেশ বৈদ্যের সাথে ১৯৯৪ সালে পারিবারিক ভাবে ঘর বাধেন জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের সাচনা গ্রামের দিগেন্দ্র বৈদ্যের মেয়ে মনি বৈদ্য। কিছু দিন পর সাচনা বাজারে ব্যবসা সূত্রে স্বামীসহ ভাড়া বাসায় উঠেন তারা। দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে অভাবের সংসার হলেও সন্তানদের পড়ালেখায় আগ্রহী স্বামী-স্ত্রী দুজনই। স্বপ্ন দেখতেন ছেলে মেয়েরা উচ্চ শিক্ষিক পরিবারের অভাব দূর করবেন। প্রয়োজনে না খেয়ে ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার খরচ জোগান তারা।
মনির সব আশা দুঃস্বপ্নে পরিনত হয় ২০১০ সালে স্বামীর আকস্মীক মৃত্যুতে। তখন মেয়ে কবিতা বৈদ্য ১২ বছর, অপ্রিতা বৈদ্য ৮ বছর, ছেলে সৈকত বৈদ্য ৩ বছর থাকায় মাথা গোজার জায়গা না থাকায় পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। হাতে কোন পুজিও ছিল না। তখন জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে সাচনা বাজারে কবিতা লন্ড্রী দোকান খোলে বসেন। একাজে তাকে সহায়তা করে নবম শ্রেণীর ছাত্র সৈকত বৈদ্য। স্কুল শেষে দোকানের হিসাব নিকাশ ও কয়লা আনার কাজটুকু করেন সে। দুই মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে সাচনা গ্রামে বাবার বাড়ীতে রেখে পড়াশুনা করাচ্ছেন। বড় মেয়ে কবিতা বৈদ্য জামালগঞ্জ সরকারী কলেজে ডিগ্রী শেষ বর্ষের ছাত্রী, মেঝ মেয়ে অপ্রিতা বৈদ্য সাচনা বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে এস এস সি পরীক্ষার্থী, ছোট ছেলে সৈকত একই স্কুলে নবম শ্রেণী ছাত্র। তিন ছেলে মেয়েকে লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষিত করেছেন সততা নৈতিকতার সাথে। মনি বৈদ্য স্বপ্ন দেখেন তার তিন ছেলে মেয়ে অভাবের মাঝেও পড়ালেখা করে এগিয়ে যাবে অনেক দূর। সন্তানদের হাত ধরেই তার আধার ঘরে চাঁদের আলো আসবে এক দিন।
চোখে ছল ছল পানি নিয়ে মনি বৈদ্য জানান স্বামীর লন্ড্রীর কাজে সুখেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার তছনছ হয়ে যায়। এরপর আমার সংগ্রাম শুরু। তিন ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগার করা যেমন দুরূহ ছিল তেমনি তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া ছিল অসাধ্য। মাঝে মাঝে বিধবা মা কিছু সাহায্য করলেও তা ছিল খুবই কম। এই কাপড় লন্ড্রীর দোকান থেকে নিজের এবং ছেলে মেয়েদের খাওয়া লেখাপড়ার করার খরচ জোগাতে হয়। ভোর হতে রাত অবধি এই লন্ড্রী দোকানে হারভাঙ্গা পরিশ্রম করে নিজের দুটি হাতকে কর্মের হাতে পরিনত করেছি। তিনি আরো বলেন যত কষ্টই হউক ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করবো না। তিন সন্তান লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি।
মনি বৈদ্যের ছেলে সৈকত বৈদ্য জানান মায়ের এই কষ্ট দেখলে খুবই খারাপ লাগে। কিন্তু আমি ছোট থাকায় বাবা মারা যায়। বাধ্য হয়েই সংসারের হাল ধরেন মা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে জোড় দাবি জানাচ্ছি জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী আমাদেরকে যেন দুই শতক জায়গা সহ একটি ঘর দেন।
এব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ জানান মানুষের কাছে মনি বৈদ্য অনুকরনীয়, তার কর্মস্পৃহা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। উপযুক্ত সহযোগিতা পেলে তার ছেলে মেয়েরা এগিয়ে যাবে। তার সন্তানরা একদিন সব দুঃখ ঘোছিয়ে ঘর আলোকিত করবে। আগামীতে তাকে ঘর সহ জায়গা দেওয়ার জন্য জোড় সুপারিশ করা হবে।