|| বার্তা সারাবেলা ||
করোনাদুর্যোগের এই সময়েও টিকা দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় এমন রোগ থেকে শিশুদের রক্ষা গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনোবা নদী ও কচুরিপানার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েই তারা যাচ্ছেন বাড়ি বাড়ি।
এমনি একজন স্বাস্থ্যকর্মী বীণা রানী। বয়স ৫০ বছর। শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের টিকা নিশ্চিত করতে মাইলের পর মাইল ছুটে চলেন বীণা। তিনি কাজ করেন সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত এলাকায়।
তার কাছেই মেলে যক্ষ্মার টিকা বিসিজি। এছাড়া ডিপথেরিয়া, ধনুষ্টঙ্কার ও হুপিং কাশি, হেপাটাইটিস বি, হ্যামোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, নিউমোকোকাস, পোলিও এবং হাম ও রুবেলার টিকা নিয়ে হাজির হন স্বাস্থ্যকর্মী বিণা।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে মা-বাবারা উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তাদেরদেখানোর চেষ্টা করি যে, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পরে এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করেই আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারি।
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা ও শারীরিক দূরত্ব রক্ষার নির্দেশনার মধ্যেই বীণা রাণী ছুটে চলেছেন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি।
বর্ষার বৃষ্টি আর শীতের ঠান্ডা সব পরিস্থিতিতেই পায়ে হেঁটেই কষ্টসাধ্য কাজটি করে চলেছেন তিনি। শুধু করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিই নয়, বীণা রানীর কাজটি সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। কারণ তাকে কাজ করতে হয় সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায়। যেখানে পায়ে হাঁটাই একমাত্র ভরসা।
বীণা রানী বলেন, “প্রতি মাসে আমাকে আটটি কেন্দ্রে টিকা পৌঁছে দিতে হয়। দুইটি নদী পেরিয়ে, কচুরিপানার মধ্য দিয়ে আমি হেঁটেই যাই।” তিনি আরও বলেন, “কাজটি শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য ও ক্লান্তিকর। তবে আমাদের একজন স্বাস্থ্যকর্মীও খুঁজে পাবেন না, যার মধ্যে উৎসাহে কোনো ঘাটতি রয়েছে।”
আগে তাও কোন কোন জায়গায় যেতে পরিবহণ মিলত, কিন্তু এই করোনাসময়ে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় আট কিলোমিটার পথ হেঁটে শেষ প্রান্তের টিকদান কেন্দ্রে যেতে হয় বীনা রানীকে। আবার ওই আট কিলোমিটার পথ হেঁটেই ফিরতে হয় বাড়িতে। সেখানে যাতায়াতে নৌকার ব্যবস্থা নেই, বাসও নেই”- বলেন বীণা রানী।
শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বীণার এই ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বাংলাদেশে টিকা প্রদান ব্যবস্থার উন্নতি না হলে, হাম ও অন্যান্য অসুখ গুরুতর আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ২০২০ সালের শুরুতে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়ার মাধ্যমে টিকা প্রদানের লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ সংকট ও করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করতে হয়েছে ।
করোনা পরিস্থিতিতে শিশুদের টিকা নিতে মা-বাবাদের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত অনাগ্রহের কথা জানিয়ে বীনা রানী বলেন, অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সন্তানকে নিয়মিত টিকা দিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিতে পারছেন না বাবা-মা। তাদের মধ্যে অনিচ্ছাকৃত এই অনাগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় হাম ও রুবেলা টিকাদান কর্মসূচির আওতায় ৯ মাস থেকে ৯ বছর বয়সী ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য অর্জনের কর্মসূচি স্থগিত করার পরপরই দেশের কিছু কিছু স্থানে হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক উপদেষ্টাদের পরামর্শ অনুযায়ী কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও নিয়মিত টিকা প্রদান বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে টিকাদানের বিষয়টি স্থায়ী ও প্রচারণা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু দেশের যেসব এলাকায় লকডাউন চলছে, সেসব এলাকায় শিশুরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না আসায় টিকা নেওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
বীণা রানীর মতে টিকার সুফল সম্পর্কে সাধারণত দরিদ্র মানুষকে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না, বরং যারা ধনী তাদের মধ্যেই টিকা নেওয়ার ব্যাপারে অনিহা রয়েছে। ‘আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের টিকা নিতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি। তাদের বাড়িতে যাই এবং শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করেই আমরা তাদের বোঝনোর চেষ্টা করি। এই সময়ে শিশুদের টিকা দেওয়া যে নিরাপদ সেটিও আমরা তাদের কাছে ব্যাখ্যা করছি’- বলেন স্বাস্থ্যকর্মী বিণা রানী।
অপ্রতিরোধ্য স্বাস্থ্যকর্মী বীণা জানান, কোভিড-১৯ নিয়ে তার ওই এলাকায় মানুষের মধ্যে এখনো তেমন ভয় তিনি লক্ষ করছেন না। তবে অন্যান্য রোগের কিছু টিকার বেশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এমন নজিরও রয়েছে যে, অনেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের টিকা দেওয়ার জন্য পরিস্থিতি ভালো হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন; কিন্তু আমরা তাদের বলছি, তাতে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।’
বীণা রানী এও বলেন, ‘আমরা টিকাদান শুরুর বিষয়টি মাইকে ঘোষণা করার জন্য স্থানীয় মসজিদের ইমামদের অনুরোধ করি, যাতে গ্রামের কেউই খবরটি পাওয়া থেকে বাদ না পড়ে।’
বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে ।
সংবাদসূত্র: ইউনিসেফ