|| সারাবেলা প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ ||
সংস্কার করা হবে এই বলে গেল ৬ মাস ধরে চলছে না ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের মধ্যে চলাচলকারী আন্ত:নগর ট্রেন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হিসেবে গেল কয়েক বছর আগে চালু হয় এই ট্রেন।
চালু হবার পর থেকেই এসি স্লিপার কেটে নেয়া, নতুন ইঞ্জিনের পরিবর্তে পুরনো ইঞ্জিন জুড়ে দেয়া, এসি বগি কেটে নেয়া, আসন বন্টন জটিলতার মত নানা কারণে ট্রেনটির সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বারবার। এবারে সংস্কারের নামে বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে এই জেলার মানুষের একমাত্র রেলসেবা। গেল ৬ মাস ধরে এই সেবা বন্ধ থাকায় স্থানীয়দের মধ্যে বাড়ছে ক্ষোভ-সংক্ষোভ।
বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কে সারাদেশের বিভিন্ন রুটে ইতোমধ্যেই ৬০টি ট্রেন চালু করা হলেও এই ট্রেনটি চালু না করাকে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছে স্থানীয়রা। ট্রেনটি দ্রুত চালুর দাবিতে আন্দোলনে যাওয়ার হুশিয়ারিও দিয়েছে সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটি।
বাজার স্টেশন রেলওয়ে স্টেশন, স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটিসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯১৫ সালে পাকশি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু হবার পর সেতু থেকে সিরাজগঞ্জ বাজার পর্যন্ত শুরু হয় রেল যোগাযোগ। এর কিছুদিন পর জামালপুরের জগন্নাথগঞ্জ ঘাট থেকে ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন পর্যন্ত রেল যোগাযোগ চালু হলে বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্কে সিরাজগঞ্জের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
অবিলম্বে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করার দাবি জানিয়ে সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বলেন, আমরা রেলওয়ে কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি, রেলসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে যে কোন কর্মসূচি নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) জেলা শাখার আহ্বায়ক ও স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটি’র সংগঠক কমরেড নব কুমার কর্মকার বলেন, সিরাজগঞ্জবাসির স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনে অর্জিত ট্রেন নানা অজুহাতে বন্ধ করার ষড়যন্ত্র মেনে নেয়া হবে না। স্বল্পব্যয়ের সহজলভ্য ও আরামদায়ক যাতায়াতের বাহন ট্রেন বন্ধ করে উচ্চব্যয়ে বিকল্প পরিবহনে যাতায়াতে বাধ্য করার মাধ্যমে সাধারন যাত্রীদের পকেট কাটার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শিগগিরই সিরাজগঞ্জবাসিদের সংগঠিত করে আন্দোলনে যাবে স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটি।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হবার পর শহরের ৭ কিলোমিটার দূরে সদানন্দপুর শহীদ এম মুনসুর আলী রেলওয়ে স্টেশন ব্যাবহার করে ঢাকা-উত্তর-দক্ষিনবঙ্গে ট্রেন চলাচল করতে থাকে। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ের রেল নেটওয়ার্কে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে সিরাজগঞ্জ শহর ও এর আশপাশের কয়েক লাখ মানুষ। এক সময় বন্ধই করে দেওয়া হয় সিরাজগঞ্জ শহরের সঙ্গে সব ধরণের রেল যোগাযোগ।
এই অবস্থায় রেলসেবা বঞ্চিত সিরাজগঞ্জবাসি স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে ২০০০ সাল থেকে “হয় রেল-নয় জেল’ স্লোগানে আন্দোলন শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ৯ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিরাজগঞ্জ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের জনসভায় সিরাজগঞ্জকে রেলনেটওয়ার্কের আওতায় আনার ঘোষনা দেন। তার এই ঘোষনার বাস্তবায়ন করতে ২০১৩ সালের ২৭শে জুন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস চালু হয়। ঐ সময়ে পুরাতন ইঞ্জিন ও বগি সম্বলিত ট্রেনটি সকাল ৭ টায় ঈশ্বরদি থেকে ছেড়ে বেলা ১০টায় সিরাজগঞ্জ বাজার হয়ে ঢাকার কমলাপুরে যাতায়াত শুরু করে।
যাত্রী কম হওয়ায় আবারও ২০১৫ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ট্রেনটির সময় ও রুট পরিবর্তন করে ভোর ছয়টায় সিরাজগঞ্জ বাজার থেকে যাত্রা শুরু করে সরাসরি ঢাকায় আবার বিকেল পাঁচটায় ঢাকার কমলাপুর থেকে ছেড়ে রাতে সিরাজগঞ্জ বাজারে আসা যাওয়া শুরু করে।
যাত্রী সুবিধা বিবেচনায় সময়সূচি পরিবর্তন ও নতুন কোচ সংযোজন করায় সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস বেশ গ্রহনযোগ্য ও লাভজনক হয়ে ওঠে এই যাতায়াত ব্যবস্থা।
তবে দৃশ্যমান কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ করেই ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস থেকে কিছু জনবল ও এসি স্লিপার কোচ প্রত্যাহার করা হয়, একই সঙ্গে প্রত্যাহার করা হয় সিরাজগঞ্জ বাজার রেলওয়ে স্টেশনের জনবলও। একই সময়ে নতুন আসন বন্টন করা হয়। নতুন বন্টনে শুরুর স্টেশন সিরাজগঞ্জ থেকে আসন সংখ্যা কমিয়ে তা বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব, টাঙ্গাইল ও জয়দেবপুর স্টেশনের অনূকুলে দেওয়া হয়।
এই অবস্থায় চলাচল অব্যাহত থাকতেই গত বছরের শেষদিকে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস থেকে এসি বগি কেটে নেয়া হয়। এরপর চলতি বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সংস্কারের অজুহাতে আচমকা ট্রেনটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ঐ সময়ে সংস্কার কাজ শেষ করে অতিদ্রুত সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি পুনরায় চালু করা হবে বলে জানানো হলেও ট্রেনটি চালু না করে সময়ক্ষেপন করতে থাকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস চালু করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের নানা তালবাহানা অব্যাহত থাকতেই দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। গত ২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় বন্ধই করে দেওয়া হয় যাত্রীবাহী এই ট্রেনটি। দুই মাস পর গত ৩১শে মে প্রথম দফায় আট জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হয়। গত ৩রা জুন দ্বিতীয় দফায় আরও ১১ জোড়া ট্রেন বাড়ানো হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ৩৪টি ট্রেন চলাচল করছে। ১৭ই আগস্ট রোববার রেলের বহরে যুক্ত হয়েছে আরও ২৬টি ট্রেন। সবমিলিয়ে এখন চলাচল করা ট্রেনের সংখ্যা ৬০টি, অর্থাৎ ৩০ জোড়া ট্রেন ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে চলতি আগস্ট মাসের মধ্যেই পর্যায়ক্রমেই সব ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নতুন আরো যে কয়েকটি ট্রেন চালু হতে যাচ্ছে সেই সব ট্রেনের প্রারম্ভিক স্টেশনে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশনা পৌঁছেনি সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রারম্ভিক স্টেশন সিরাজগঞ্জ বাজার রেলওয়ে স্টেশনে। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ধারনা সহসাই চালু হচ্ছে না সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন।
সিরাজগঞ্জ বাজার রেলওয়ে স্টেশনের বুকিং সহকারি মো. জুলহাস উদ্দিন জানান, চলতি মাসের ৩১শে তারিখের মধ্যে আরো বেশ কিছু ট্রেন চালু হবে কিন্তু সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করার কোন নির্দেশনা লিখিত বা মৌখিক আকারে আমরা এখনো পাইনি।