সংঘর্ষ নয়, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

যশোরের এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে লাশ উদ্ধার ও মারধরের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সুপারিশও করেছিল।

|| সারাবেলা প্রতিনিধি, যশোর ||

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নয়, বরং কর্মচারীদের পিটুনিতেই মারা গেছে তিন কিশোর। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ বলছে, এমন অভিযোগের যৌক্তিকতাও রয়েছে বলে মনে করেন তারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে যশোর সদর উপজেলার পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়, আহত হয় আরও অন্তত ১০ জন।

উল্লেখ্য, যশোরের এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে লাশ উদ্ধার ও মারধরের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সুপারিশও করেছিল।

এদিকে ঘটনার পর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের বরাতে প্রাথমিক তথ্যে বন্দি কিশোরদের ‘দুই পক্ষের সংঘর্ষে’ হতাহতের এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি কিশোরদের অভিযোগ, কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের রশি দিয়ে বেঁধে রাখে এবং দফায় দফায় পেটায়, আর তাতেই মারা যায় তিন কিশোর। আহত হয় বেশ কয়েকজন।

এ প্রসঙ্গে খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলাম বলেন, “সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। আমরা যারা অপরাধ নিয়ে কাজ করি, তারা ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে বিষয়টি জেনেছি। যে কারণে মূল ঘটনা জানা জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

তিনি এও বলেন, “এখন যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে, তারাই এই ঘটনার মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউ মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বিষয় গুরুত্ব পাবে। সবশেষ আমি বলতে চাই, এ ঘটনা একপক্ষীয়।”

যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি আহত বন্দি চুয়াডাঙ্গার এক কিশোর বলেছে, “গত ৩রা অগাস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম তার চুল কেটে দিতে বলেন। কিন্তু সেদিন আমি কেন্দ্রের প্রায় দুইশ জনের চুল কেটে দেওয়ায় হাত ব্যথা ছিল। সে কারণে তার চুল পরে কেটে দেব বলে জানালে তিনি ক্ষিপ্ত হন। এবং আমাকে গালিগালাজ করতে থাকেন। তখন এক পর্যায়ে কয়েকজন কিশোর ওই গার্ডকে মারধর করে।

কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারধর করেছে দাবি করে ওই গার্ড অফিসে নালিশ করেন। কিন্তু কিশোররা কর্তৃপক্ষকে জানায়, তারা মাদক সেবন করেনি। এমন তথ্য জানিয়ে চুয়াডাঙ্গার কিশোর আরও বলেছে, ‍“ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে আমাদের অফিসে ডাকা হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। আমরা ঘটনা জানানোর একপর্যায়ে কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকসহ অন্য স্যাররাও আমাদের মারধর করেন।”

যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার আরেক কিশোর বন্দি বলেছে, “নিহত রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই রাসেলের জামিন পাওয়ার কথা ছিল।” তার অভিযোগ, “স্যারদের বেদম মারপিট আর চিকিৎসা না পেয়ে রাসেল মারা গেছে। প্রবেশন অফিসার মারধরের সময় বলছিলেন, ‘তোদের বেশি বাড় বেড়েছে। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে।”

ঘটনার দিনের কথা জানাতে গিয়ে এই কিশোর অভিযোগ করে, মারধর করে বন্দি কিশোরদের কেন্দ্রের খোলা চত্বরে এখানে-সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে একজন করে মারা গেলে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে চার দফায় আহতদের হাসপাতালে আনা হয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তবে প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ। তার দাবি, “সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার বিকেলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। রড ও লাঠির আঘাতে মারাত্মক জখম হয় ১৪ কিশোর। প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রেই তাদের চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু আহতদের কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে একে একে তাদেরকে যশোর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে নাইম, পারভেজ ও রাসেলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।”

এদিকে হতাহতের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ জনকে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তবে এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। তিন কিশোরের পরিবারের লোকজন মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আজ শুক্রবার দুপুর ১২টায় দিকে যশোরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন এসব তথ্য জানিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, কিশোর অপরাধ সংশোধনের জন্য বালকদের জন্য দেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। এর একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলির পুলেরহাটে। যশোর কেন্দ্রে মোট বন্দির সংখ্যা ২৮০ জন বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের সহকারী পরিচারক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন