|| সারাবেলা প্রতিনিধি, বাগেরহাট ||
জোয়ারের পানিতে আমাদের বাড়িঘর, ঘের, পুকুর, রাস্তা, গোয়ালঘর, ফসলের ক্ষেত সবকিছু ডুবে গেছে। ফি বছরই আমাদের ডুবতে হয়। কিন্তু এবারই প্রথম আগাম কোন সতর্কতা পাইনি আমরা। পেলে হয়তো কিছুটা রক্ষা পেতাম। এবারতো নি:স্ব হয়ে গেলাম। –এমনি ক্ষোভ আর আক্ষেপমেশানো কথাগুলো বলছিলেন মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়নের ঘষিয়াখালীর কৃষক নুরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, মাসুদ শিকদারসহ কয়েকজন।
হঠাৎ অস্বাভাবিক জোয়ার আর ৫ দিনের টানা ভারিবৃষ্টিতে বাগেরহাট জেলার শ’য়েরও বেশী গ্রামের হাজার পরিবারের মত নুরুল, হাবিবুর আর মাসুদের পরিবারও পানিবন্দি। জীবন এখন তাদের কাছে বোঝার মত। খাবার নেই, রাতে ঘুমোবার জায়গা নেই, নেই বিশুদ্ধ জল। ঘরবাড়িতে পানিতে ডুবে থাকায় নেই রান্নাবান্নার জোগার।
অনেক এলাকায় প্রবাহমান খাল আটকে চিংড়ি চাষ করায় নামতে পারছে না পানি। সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। সেইসঙ্গে অবিরাম বৃষ্টি। এরইমধ্যে জোয়ারের পানিতে দুই বার ডুবেছে বাগেরহাট জেলা শহরের নিম্নএলাকা ও মোরেলগঞ্জ পৌরসভা। পানি ঢুকে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। হাজারের বেশী মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে গেছে। জলাবদ্ধতায় পঁচে গেছে প্রায় সব সবজির ক্ষেত।
তবে ক্ষতিগ্রস্থরা এসব ক্ষয়ক্ষতিতে দিশেহারা হলেও এখনো পর্যন্ত ক্ষতির পরিমান নিরুপণ করতে পারেনি স্থানীয় মৎস্য, কৃষি, জেলা প্রশাসন। আসেনি কোন সহায়তাও।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বলেন, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বাগেরহাটের যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে সেখান থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য স্থানীয় জন প্রতিনিধি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা হবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার কলাবাড়িয়া, চরগ্রাম, বিষ্ণুপুর, মাঝিডাঙ্গা, পালপাড়া, ভদ্রপাড়া, কাঠি, রাধাবল্লভ, গোবরদিয়া, হালিশহর, বাকেরগঞ্জ, ফকিরহাটের মাসকাটা, ধনপোতা, লখপুর, ভবনা এলাকার কয়েকশ’ পরিবার পানিতে বন্দি হয়ে পড়েছে। ওই এলাকার মানুষের মাছের ঘের, গোয়ালঘর, পুকুর, মাঠ, ক্ষেত পানিতে থৈ থৈ।
চিতলমারী উপজেলার সন্তোষপুরের ঘের চাষি জুড়াল মন্ডল, মোড়েলগঞ্জের পঞ্চকরণের আবুল কালাম ও বাগেরহাট সদর উপজেলার কাঠি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অসীমাভ ডাকুয়া বলেন, ঘের-পুকুর, ঘরবাড়ি, মাঠক্ষেত, রাস্তাঘাট সব পানিতে ভাসছে। অনেক ক্ষয়ক্ষতি হইছে। কিন্তু এবার আগে কেউ বলেনি- এত পানি হবে, বন্যা হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মোরেলগঞ্জের পঞ্চকরণ, নিশানবাড়িয়া, বহরবুনিয়া, জিউধরা, তেলিগাতি ইউনিয়নের অন্তত ৫০টি গ্রাম ভাসছে পানিতে। মানুষ পানিবন্দি। ভেসে গেছে দুই শ’র বেশী পুকুর ও মৎস্য ঘের। কচুয়া উপজেলার নরেন্দ্রপুর, ভান্ডারকোলা, পদ্মনগর, রামপালের ভোজপাতিয়া, পেড়িখালী এলাকার অবস্থাও অনুরূপ।
অশীতিপর রাহিলা বেগম বলেন, ঘরের মধ্যে পানি, রান্না করতি পারতিছি না। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির চাপে আলেয়া বেগম, সালমা বেগম, বিলকিস, মরিয়ম, আব্দুস ছালামসহ চরগ্রামের মানুষের কাঁচা ঘরের মাটি ধসে পড়েছে। ঘরে পানি উঠেছে। নিজেরা শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করলেও খাবার নেই গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর। নেই ওদের থাকবার জায়গাও।
চিতলমারীরর সবজি চাষি সবুজ শিকদার, মনোহর বিশ্বাস, প্রশান্ত হালদার, মারুফ খানের ভাষায়, চিতলমারীরর অধিকাংশ সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এনজিও’র ঋণে চাষ করা এসব সবজি নষ্ট্ হওয়ায় কী করে কিস্তি শোধ করবেন তা নিয়ে কিনারা পাচ্ছেন না এসব কৃষক।
রামপাল উপজেলার ভোজপাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ নুরুল আমিন বলেন, জোয়ারের পানিতে আমার ইউনিয়নের কয়েকশ মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। পানি উঠে সব একাকার হয়ে গেছে।