প্রধানমন্ত্রীর কথাতেও হয়নি কয়রার বাঁধ প্রতিবাদে পানিতেই ঈদনামাজ

|| সারাবেলা প্রতিনিধি, খুলনা ||

সেই আইলাতে ভেঙ্গে যাওয়া বাধটি আর মেরামত হয়নি। এটির সংস্কার দাবিতে রাষ্ট্রের কাছে ধরণা গেল ১১ বছর ধরে। এবারের ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বাঁধটির অবস্থা যারপর নাই বিপর্যস্ত। শুধু বিপর্যস্তই নয়, বলা যায় বাঁধটি একেবারে নাই হয়ে গেছে। জোয়ার এলে বাঁধটি ডুবে যায় হাঁটু সমান পানিতে। আম্পানে বেড়িবাঁধটি ভেঙে প্লাবিত হয়েছে খুলনার কয়রা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা।

বাঁধ পুন:নির্মাণ দাবিতে বাঁধের ওপর হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়েই ঈদের নামাজ পড়লেন উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। ঈদের দিনে স্বেচ্ছায় কাজ করেও ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধের পুরোটা মেরামত করা যায়নি। মঙ্গলবারও কাজ করবেন দুর্গতরা। কাজে অংশ নেওয়া মানুষগুলো দুপুরে জোয়ারের আগ পর্যন্ত আংশিক বাঁধ মেরামত শেষে খিচুড়ি খেয়ে বাড়ি ফেরেন।

গত ২০ শে মে আম্পানের তান্ডবে বেড়িবাঁধের ২৪টি পয়েন্টের বিস্তৃত অংশ ভেঙ্গে যায়। লবণ পানিতে তলিয়ে যায় উপজেলার চারটি ইউনিয়ন। এর আগে ২০০৯ সালের ২৫শে মে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলায় পাউবোর বেড়িবাঁধের ২৭টি পয়েন্ট জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে গোটা উপজেলা লোনা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল।

স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুদ্দৌলা লিঙ্কন বলেন, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়রায় আসেন এবং এলাকা ঘুরে দেখেন। তিনি সে সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এলাকায় টেকসই ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের। তারপর থেকে কয়রা এলাকায় বাঁধ নির্মাণে প্রতিবছরই অর্থ বরাদ্দ হয়; কিন্তু এ অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হয় তা কেউ বলতে পারে না।”

দক্ষিণ বেদকাশীর বাসিন্দা আবু সাঈদ খান বলেন, আইলায় বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মানুষ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। কিন্তু আম্পানে ঘর বাড়ি, বাঁধ সবই গেছে। তাই মানুষের ন্যূনতম আশ্রয় নেওয়ার অবস্থাও নেই। বাধ্য হয়ে এখন মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে আগে বাঁধ নির্মাণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাদা জলে নেমে পড়েছেন।

ইউপি সদস্য হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, কয়রার মানুষ বাঁধ মেরামত না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না। কারণ বাঁধ আটকাতে না পারলে লোনা পানির মধ্যে বসবাস করা কঠিন হবে। কয়রার মানুষ এখন ত্রাণ চায় না, বাঁধ চায়। তাই সবাই মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করলেও তাদের পেটে দানা পানি প্রয়োজন। উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ সেটুকুর জোগান দিয়ে লোনাপানিতে বিধ্বস্ত মানুষদের উৎসাহ দিচ্ছেন।

কয়রা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে সদর ইউনিয়নের ২ নম্বর কয়রা গ্রামের অন্তত ছয় হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের উপর হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন। এই নামাজে ইমামতি করেছেন কয়রা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা আ খ ম তমিজ উদ্দিন।

শফিকুল ইসলাম বলেন, “এবার অন্যরকম এক ঈদ উদযাপন করছি আমরা। স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধ নির্মাণে এসে জোয়ারের পানি যখন হাঁটুপানি পর্যন্ত পৌঁছায় তখই শুরু হয় ঈদের নামাজ। প্রায় ছয় হাজার মানুষ নামাজে অংশ নিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সবার জন্য ঈদের সেমাইয়ের ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া দুপুরে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হয়।”

কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, আইলার পর থেকে এ জনপদের মানুষ বেড়িবাঁধ নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছে। আম্পানের আঘাতে সেই যুদ্ধ আবার নতুনভাবে শুরু করতে হল। তিনি বলেন, দুপুরে জোয়ারের আগ পর্যন্ত আংশিক বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়েছে। মঙ্গলবার আবারো মেরামত করা হবে। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলে এখন কয়রার মানুষকে এত ভোগান্তি পোহাতে হত না।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, কয়রাবাসীর প্রয়োজন টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্বস্ত করেছেন কয়রাসহ উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। এখানে ভালো ফসল হয়, মাছ চাষ হয়। টেকসই বাঁধ নির্মাণ হলে কয়রার মানুষের আর ত্রাণের দরকার হবে না।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা বলেন, আইলায় বিধ্বস্ত কয়রা আম্পানে আরও মুখ থুবড়ে পড়েছে। কয়রার চারটি ইউনিয়নের সমগ্র এলাকা লোনা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এই জনপদের মানুষ এখন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণে নেমেছেন। তিনি জানান, এলাকার মানুষ ঈদের দিন বাঁধের ওপরই নামাজ আদায় করে সেমাই খেয়ে আবার বাঁধ মেরামতের কাজে নেমে পড়েন। দুপুরে তাদের জন্য খিচুড়ির আয়োজন করা হয়।

নদীবেষ্টিত উপজেলা কয়রার পূর্বদিকে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শাকবাড়িয়া নদী; দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কপোতাক্ষ এবং উত্তর পাশে রয়েছে কয়রা নদী। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে খুলনার ৯টি উপজেলার ৮৩ হাজার ৫৬০টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিতে পড়েছেন সাড়ে ৪ লাখ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়েছে কয়রা উপজেলা। এখানকার ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে ৮০ ভাগ এলাকাই প্লাবিত হয়ে পড়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ।

আম্পানের আঘাতে কয়রার চারটি ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২১টি পয়েন্টে নদী ভাঙনের কারণে এসব এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঝড় ও বন্যার কারণে কয়রা উপজেলার প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে জোয়ারের ছোটবড়ো ৫ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন