|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
করোনা মহামারীতে দেশে এসে ভিসা ও বিমান সংকটে পড়েন সৌদি প্রবাসীরা। ভিসার মেয়াদ ৩০শে সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া এবং এই সময়ের মধ্যে সৌদি বিমানের সিডিউল সংকটে দুশ্চিন্তায় পড়েন বেশীর ভাগ প্রবাসী। গেল কয়েকদিন ধরে টিকিট সংকটের সুরাহার দাবিতে সৌদি এয়ারলাইন্সের ঢাকা অফিসের সামনে বিক্ষোভ করে তারা। এক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনায় উদ্যোগি হয় বাংলাদেশ সরকার। শেষ পর্যন্ত বুধবার রাতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে এ আব্দুল মোমেন জানান, ভিসা ও ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি বিমান বাংলাদেশকে নিয়মিত ফ্লাইট পুনরায় চালুর অনুমতি দিয়েছে সৌদি আরব সরকার।
বুধবার রাত ৯টার দিকে প্রেস ব্রিফিং করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সৌদি আরব প্রবাসী যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে, তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়াতে সম্মত হয়েছে সৌদি সরকার। তিনি বলেন, “সৌদি সরকারকে অ্যাপ্রোচ করেছিলাম মেয়াদ বাড়ানোর জন্য, যাদের মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়েছে। তারা এতে সাড়া দিয়েছে। রোববারে সৌদি মিশন খুলবে। যাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তারা বাড়িয়ে নিতে পারবে।”
এছাড়া আরবি সফর মাসে যাদের ইকামার মেয়াদ শেষ হবে, তাদের ইকামার মেয়াদও ‘ভ্যালিড বলে গণ্য হবে’ বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একইসঙ্গে মন্ত্রী একথাও জানান যে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট স্বাভাবিকভাবে চলার অনুমতিও পাওয়া গেছে সৌদি সরকারের তরফ থেকে।
সৌদি আরবে ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে যে এক হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে তার মধ্যে ৪০১ কোটি ৫১ লাখ ডলারই পাঠিয়েছেন সৌদি প্রবাসীরা।
করোনা মহামারীসময়ে এসব প্রবাসীদের মধ্যে যারা দেশে এসেছিলেন, তাদের বেশীর ভাগেরই ভিসার মেয়াদ ৩০শে সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার কথা। এই পরিস্থিতিতে সৌদি সরকার বিমান চলাচল ফের শুরু করলেও ফ্লাইট সংখ্যা কম থাকায় টিকিট সংকটে পড়েন প্রবাসীরা। অন্যদিকে সৌদি সরকারের অনুমতি না মেলায় সেদেশে নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইটও চালু করতে পারছিল না বাংলাদেশ বিমান। যে কারণে অনেক প্রবাসী বিমানের টিকিট কেটে রেখেও যেতে পারছিলেন না।
এই পরিস্থিতিতে সৌদি প্রবাসী কর্মীরা নামেন বিক্ষোভে। তারা বিমান ও সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্স অফিসের সামনে দুদিন বিক্ষোভের পর বুধবার প্রবাসী কল্যাণ ভবনের সামনেও বিক্ষোভ করেন। বুধবার সকাল ৯টার দিকে কয়েকশ প্রবাসী কারওয়ান বাজারে সোনারগাঁও হোটেল চত্তরে সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসের সামনে অবস্থান নেন। এতে কিছু সময়ের জন্য সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর বেলা ১১টার দিকে তারা ইস্কাটনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের আরেকটি দল বেলা ১২টার দিকে মতিঝিল থেকে মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন।
তাদের কথা, এ মাসের মধ্যে সৌদি আরব যেতে না পারলে অনেকেই চাকরি হারাবেন। সে কারণে তাদের দ্রুত ফেরার ব্যবস্থা না করার কোন বিকল্প নেই। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি সেখানে যাওয়ার টিকিটও লাগবে তাদের।
দুপুরের পর বিক্ষুব্ধ সৌদি প্রবাসীদের ছয়জন প্রতিনিধির সঙ্গে আলেচনায় বসেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমেদসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তারা। মন্ত্রীর আশ্বাসে মন্ত্রণালয়ের সামনে থেকে অবরোধ তুলে দেন প্রবাসীরা।
এর মধ্যে প্রবাসীদের অবস্থা নিয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের উপর ভরসা রাখার আহ্বান জানান সরকারের মন্ত্রীরা। পরে বুধবার রাত ৯টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। বিমানের ফ্লাইট চালুর পাশাপাশি ভিসা ও ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে জটিলতার অবসান হতে চলেছে বলে জানান তিনি।
ইকামার মেয়াদ বাড়ানো প্রসঙ্গে মোমেন বলেন, “ইকামা বা ওয়ার্ক পারমিট ব্যক্তিগত, কর্মীর নিয়োগকর্তা দেয়। নিয়োগকর্তা তা দিলে তাদের স্পেসিফিক ডিপার্টমেন্ট সেটার অনুমোদন করে। এ সময়ে যেতে না পারার কারণে যদি ওয়ার্ক পারমিট বাতিল হয়, তাহলে কি হবে? ওনারা বললেন, এই আরবি মাস সফরের মাস, এই সফরের মাসে আমরা ইকামাটা ভ্যালিড বলে গণ্য করব।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিমান ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্স বন্ধ থাকায় যারা যেতে পারেননি, এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাদের যাওয়ার ’রাস্তা খুলে গেল’।
গত কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আররের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন, তার কারণে সৌদি সরকার এই সুপারিশগুলো আমলে নিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এখন কেবল সৌদি বাদশাহর রাজকীয় আদেশ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “সৌদি আরবে সব সিদ্ধান্ত কার্যকরের সময় ’রয়্যাল ডিক্রি’ লাগে। বাদশাহর একটি আদেশ লাগে। কতক্ষণে উনার কাছে এটা পৌঁছানো যায়, তখন বুঝা যাবে সুনির্দিষ্টভাবে কখন রয়্যাল ডিক্রিটা জারি হয়।”
বিমানের বাণিজ্যিক ফ্লাইট ১লা অক্টোবরের পর
এদিকে সঙ্কটসময়ের এই পরিস্থিতিতে সৌদি আরবে দুটি বিশেষ ফ্লাইট চালানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিমান। নিয়মিত ফ্লাইটের অনুমতি না মিললেও বিশেষ ফ্লাইটের অনুমতি রয়েছে তাদের। আগামী ২৬শে সেপ্টেম্বর একটি ফ্লাইট জেদ্দার উদ্দেশে এবং ২৭শে সেপ্টেম্বর আরেকটি ফ্লাইট রিয়াদের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন।
বিমান বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের এমন অবস্থান জানানোর কিছুক্ষণ পর বুধবার রাত ৯টার ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানান, সৌদি সরকারের কাছ থেকে বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইট চালুর অনুমতি পাওয়া গিয়েছে। তিনি বলেন, “সৌদি সরকার আমাদের বিমানের যতগুলো ফ্লাইট সেগুলো তারা ওপেন করে দিয়েছে। এখন আমাদের প্রবাসীরা সৌদি আরবে গিয়ে কাজকর্ম করতে পারবে।”
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশের জনসংযোগ উপ-মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার বলেন, ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেদ্দা ও রিয়াদে কয়েকটি বিশেষ ফ্লাইট চালাবে বিমান। এছাড়া সৌদি সরকার ফ্লাইট চালানোর অনুমতি দেওয়ায় পয়লা অক্টোবর থেকে দেশটিতে বিমান বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালানোর পরিকল্পনাও নিয়েছে বলে জানান তাহেরা খন্দকার। তবে কোন কোন গন্তব্যে কয়টি ফ্লাইট চলবে সেটি পরে জানানো হবে বলে জানান বিমানের এই কর্মকর্তা।
এর আগে অবশ্য বিমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ঘোষিত দুই বিশেষ ফ্লাইটে কেবল তারাই যেতে পারবেন, যাদের সৌদি আরবে ফেরার টিকিট (রিটার্ন টিকিট) কেটে রাখা আছে। এ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির খান বলেন, ১৬ ও ১৭ই মার্চ জেদ্দা ও রিয়াদের বিমানের রিটার্ন টিকিট রয়েছে এমন প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ফ্লাইট দুটি চালানো হবে। এই ফ্লাইটে বুকিংয়ের জন্য বিমানের সেলস অফিসে বৃহস্পতিবার ২৪শে সেপ্টেম্বর যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান তিনি।
আটকে পড়া বাকিদের বিষয়ে বিমান এমডি বলেন, ফ্লাইট অনুমোদন সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে অন্য যাত্রীদেরও বুকিংয়ের জন্য জানানো হবে। অন্য যাত্রীদের এখনই অযথা কাউন্টারে ভিড় না করতে অনুরোধ করেন তিনি। তবে এসব যাত্রীদের অবশ্যই কোভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ সঙ্গে রাখতে হবে।
বিমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক এবং নমুনা সংগ্রহের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সৌদি আরব পৌঁছতে হবে বলে সব যাত্রীকে ঢাকা থেকে কোভিড পরীক্ষা করতে হবে এবং ঢাকা থেকেই যাত্রা করতে হবে।”