|| সারাবেলা ডেস্ক ||
স্বাধীনতা যুদ্ধের সমরনেতা ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জেনারেল(অব.) চিত্তরঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত) আর নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বয়েন্টনবিচের বেথেসডা সাউথ হাসপাতালের হসপিস কেয়ার ইউনিটে স্থানীয় সময় সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল) বীর এই সেনার জীবনাবসান ঘটে।
মেয়ে জামাই প্রদীপ দাসগুপ্ত জানান, “গত বৃহস্পতিবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালি ভেঙে যায় তার শ্বশুরের। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার পায়ে অস্ত্রোপচারও করা হয়। সে সময় উনাকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করতে হয়েছিল। উনি ছিলেন অ্যাজমার পেশেন্ট। সার্জারির পর তার শ্বাসকষ্ট মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়, কিডনিও অচল হয়ে পড়ে।”
কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংজ্ঞা ফেরানো সম্ভব হলেও পরে অবস্থার আরও অবনতি হয়। সোমবার দুপুরেই চিকিৎসকরা তাকে ফেরানোর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে জানান প্রদীপ। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য করতে চান তারা। তার আরেক মেয়ে কানাডা থেকে ঢাকায় যাচ্ছেন বাবার মরদেহ গ্রহণ করার জন্য।
মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, “তিন দিন আগে তিনি বাসায় পড়ে গিয়েছিলেন। পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। এরপর আর ফিরলেন না। চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।”
অবসর জীবনে বাংলাদেশে থাকতে সি আর দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বীর উত্তম খেতাবধারী এই মুক্তিযোদ্ধার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
মুক্তিযুদ্ধের এই সমরনেতার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। শোকবিবৃতিতে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান জাতি “চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানিয়েছেন শোক। বলেছেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।”
সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবার পর থেকে দেশেই ছিলেন সি আর দত্ত। সক্রিয় ছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ দেশের মানুষের অধিকার ও মর্যাদার রক্ষার নানা কার্যক্রমে। গেল বেশ কয়েক বছর আগে বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত ও ছেলে ডা. রাজা দত্তের সঙ্গে থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমান তিনি।
জন্ম, বেড়ে ওঠা, কর্মজীবন ও মুক্তিযুদ্ধে উপস্থিতি
আসামের রাজধানী শিলংয়ে ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি জন্ম নেন সি আর দত্ত। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। প্রাথমিক শিক্ষা শিলংয়ে শুরু হলেও পরে তার পরিবার স্থায়ীভাবে চলে আসে হবিগঞ্জে।
হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাসের পর খুলনার দৌলতপুর কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন সি আর দত্ত। ১৯৫১ সালে যোগ দেন তখনকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন সি আর দত্ত। সেই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির যুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের চূড়ান্ত মুহূর্ত যখন উপস্থিত, সে সময় ছুটিতে দেশেই ছিলেন সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের মেজর সি আর দত্ত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর সেক্টর ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান।
সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান তিনি। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন তিনি। রণকৌশলের অংশ হিসেবে পরে রশীদপুর থেকে ক্যাম্প সরিয়ে নেন মৌলভীবাজারে। ওই সেক্টরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার বেশ কয়েকটিতে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব ও অবদানের জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তার দায়িত্ব দেওয়া হয় সি আর দত্তকে। বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহা পরিচালক ছিলেন তিনি।
পরে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান সি আর দত্ত।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন সি আর দত্ত। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ আহমেদ ও সেক্রেটারি মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারি, আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার ও সেক্রেটারি শহীদুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক নব্যেন্দু বিকাশ দত্ত।