|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
পেঁয়াজের বাজার আবারও অস্থির। মাত্র কয়েক দিনে কেজিতে পেঁয়াজের দাম প্রায় ৩০ টাকা বেড়ে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় উঠেছে। রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। নির্ভরশীলতা কাটাতে বিকল্প আমদানিবাজার খুঁজছে সরকার ও ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলছেন, এখনো রফতানি বন্ধের খবর সরকারের কাছে নেই। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ভারত আসলেই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে কিনা খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
চলতি মাসের প্রথম থেকেই অস্থিরতা চলছে পেঁয়াজের বাজারে। সব ধরনের পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ৩০ টাকা করে বেড়ে বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একমাস আগেই দেশের বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকার মধ্যে ছিল। ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা।
ভারতনির্ভরতায় বিশেষজ্ঞমত
এই পরিস্থিতিতে পেঁয়াজে ভারত-নির্ভরতা সম্পর্কে খোদ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: নাসিরুজ্জামান বলছেন, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের গরুর খামারিরা যে সাফল্য দেখিয়েছে, সেটি পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সম্ভব। তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, ভারত থেকে যদি পেঁয়াজ না আসতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশের কৃষক উৎপাদিত পেঁয়াজের ভালো দাম পেতো”
সরকাররের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে বছরে পেঁয়াজের প্রয়োজন ৩০ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে বছরে ২৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। মাঠ থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত সময়ে নস্ট হয় প্রায় পাঁচ লাখ টন। সেই হিসাবে বাজারে পৌঁছানো যায় ১৯ লাখ টন পেঁয়াজ। ঘাটতি ১১ লাখ টন আমদানি করতে হয়।
কৃষি সচিব বলেন, “আমাদের চাষীদের যে সক্ষমতা আছে, সেক্ষেত্রে তারা খুব সহজেই ৩০ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি যখন চাষীরা পেঁয়াজ উৎপাদন করে বাজারে নিয়ে আসবে, তখন যেন ভারত থেকে আপাতত পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখে।”
এছাড়া বাংলাদেশের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজের ক্ষেত্রে কেজি প্রতি ১০-১২ টাকা পায়। ভারত থেকে পেঁয়াজ না আসলে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৩০-৩২ টাকা পেতো বলেও জানান কৃষি সচিব।
পরিস্থিতি সামালে যা করছে সরকার
ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ ইতোমধ্যেই তৎপর সরকার হয়েছে বলে জানা গেছে। বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ অব্যাহত রাখছি।’ বিকল্প মার্কেট হিসেবে অন্যান্য দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করার কথা জানিযেছেন তিনি। বাজার স্বাভাবিক রাখতে পেঁয়াজ আমদানির ওপর আরোপিত পাঁচ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআরকে) চিঠিও দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
জরুরি ভিত্তিতে তুরস্ক থেকে এক লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া জিটুজি বৈঠকের পর মিয়ানমার থেকে ফের পেঁয়াজ আমদানি শুরু হচ্ছে শিগগিরই। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে এই পেঁয়াজ জাহাজে করে দেশে আনবেন বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা।
শুরু হয়েছে টিসিবির ট্রাক সেল
টিসিবির ট্রাক থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ৩০ টাকায়, যা একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি কিনতে পারবেন। এছাড়া প্রতি কেজি চিনি পাওয়া যাবে ৫০ টাকায়, যা একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি কিনতে পারবেন। মসুর ডাল ৫০ টাকা কেজিতে একজন ক্রেতা সার্বোচ্চ দুই কেজি নিতে পারবেন। এছাড়াও সয়াবিন তেল ৮০ টাকা লিটারে একজন ক্রেতা দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লিটার নিতে পারবেন।
দেশব্যাপী ২৭৫ জন ডিলারের ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে এ বিপণন চলছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৪০টি, চট্টগ্রামে ১০টি, রংপুরে সাতটি, ময়মনসিংহে পাঁচটি, রাজশাহীতে পাঁচটি, খুলনায় সাতটি, বরিশালে পাঁচটি, সিলেটে পাঁচটি, বগুড়ায় পাঁচটি, কুমিল্লায় পাঁচটি, ঝিনাইদহে তিনটি ও মাদারীপুরে তিনটি করে মোট ১০০টি ট্রাক থাকবে।
অন্যান্য জেলার প্রতিটিতে দুটি করে ১০৪টি এবং আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাভুক্ত উপজেলার জন্য পর্যায়ক্রমে অতিরিক্ত পাঁচটি করে মোট ৬০টি ট্রাকে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে। এছাড়া বন্যাকবলিত জেলা তথা ময়মনসিংহে চারটি, রংপুরে চারটি, বগুড়ায় তিনটি, মাদারীপুরে অতিরিক্ত দুটি করে ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হবে।
পেঁয়াজের সার্বিক বিষয় সম্পর্কে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন জানিয়েছেন, সরকার পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। এবার গতবারের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির কোনো শঙ্কা নেই জানিয়ে তিনি বলেছেন, গতবার একেবারে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এবার আমরা খুব সতর্ক। টিসিবিসহ দেশে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভারতের রফতানি বন্ধ
সোমবার ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। কাঁটা টুকরা ও গুঁড়া ছাড়া সব ধরনের পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে তাদের এক নোটিফিকেশনে বলা হয়েছে। এই ঘোষণার পর সীমান্তে বাংলাদেশ অভিমুখী পেঁয়াজের ট্রাক আটকে দিয়েছেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রতি মেট্রিক টন ২৫০ ডলারের এলসির এই পেঁয়াজ এখন বর্ধিত মূল্য ৭৫০ ডলারে এলসি করলেই সেগুলো ছাড়া হবে।
প্রসঙ্গত দেশের বাজারে দাম বাড়া ও মজুদে কম পড়ায় গত বছরও ঠিক এই সেপ্টেম্বরেই ভারত প্রথমে পেঁয়াজের রফতানি মূল্য বাড়ায়। পরে বন্ধই করে দেয় পেঁয়াজ রফতানি। যার অভিঘাতে বাংলাদেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম, ৫০-৬০ টাকা কেজি দামের পেঁয়াজ বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকায়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে মিয়ানমার, পাকিস্তান, চীন, মিশর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা রঙের ও স্বাদের পেঁয়াজ আমদানি করে সরকার। নতুন পেঁয়াজ ওঠার পর গত মার্চে পেঁয়াজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ভারত।
এখন আবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণ সম্পর্কে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “দাম বেড়ে গেছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারেও ঘাটতি রয়েছে। মওসুমের কারণে এই ঘাটতি দেখা দিলেও কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেই গত কয়েক মাসে বিপুল পরিমাণ রফতানি হয়েছে।” দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের এপ্রিল-জুনে ২৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পেঁয়াজ রফতানি করেছে ভারত, যেখানে গেল অর্থবছরের পুরো সময়ে ৪৪ কোটি ডলার মূল্যের পেঁয়াজ রফতানি করেছে দেশটি।