|| সাদ্দাম হোসাইন, টেকনাফ (কক্সবাজার) ||
কক্সবাজারের টেকনাফে স্থানীয়দের অপহরণ করে মূক্তিপন দাবি এবং মুক্তিপন দিতে না পারলে খুনসহ অন্যান্য অপরাধের তালিকা বড় হচ্ছে দিনকে দিন। সম্প্রতি অপহৃত স্থানীয় ২ যুবককে অপহরণ করে তাদের স্বজনের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করে দুর্বৃত্তরা। সোমবার ঈদের দিন এই দুই যুবকের মৃতদেহ পাওয়া যায় স্থানীয় আঞ্জুমান খালের কিনারে। পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠিয়েছে। এসব অপরাধের জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করছেন স্থানীয়রা।
সোমবার ঈদের দিন ভোর ৪ টার দিকে উপজেলার হোয়াইক্যং উলুবনিয়া এবং উখিয়া উপজেলার পালংখালীর মধ্যবর্তী আঞ্জুমান খালের কিনারে অপহৃত যুবকদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দা মোস্তাফিজ কাঁকড়া শিকারের হাত বাঁধা ও মাথা এবং নাক-মুখে আঘাতের চিহ্নসহ একজনের মৃতদেহ দেখতে পেয়ে স্থানীয়দের খবর দেয়।

পরে স্বজনেরা মৃতদেহ শনাক্ত করে জানান, এই যুবক কাটাখালী পূর্ব পাড়ার মিয়া হোসেনের ছেলে আবদুর রশিদ ওরফে সাদেক। তাকে গেল ২৪শে মে রাতে এলাকার মাছের ঘের থেকে অপহরণ করা হয়। স্বজনদের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা স্থানীয়দের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি ও অন্যান্য অপরাধ করে আসছে। এদের দুর্বৃত্তপনায় এলাকাবাসী আতঙ্কিত।
স্থানীয়রা জানান, গেল ২৪শে মে ভোররাত আড়াইটার দিকে উপজেলার হোয়াইক্যং কাটাখালী পাহাড়ি এলাকা মিনাবাজার থেকে ইদ্রিসকে নিয়ে স্বশস্ত্র রোহিঙ্গারা নেমে আসে। তারা হৈ চৈ শুরু করলে পূর্ব ঊলুবনিয়া মাছের ঘেরে থাকা রশিদ ওরফে সাদেক টর্চ লাইট মেরে পরিচয় জানতে চায। তখন ডাকাত দল ক্ষুদ্ধ হয়ে ঘেঁরে থাকা লোকজনের ওপর চড়াও হলে ইদ্রিস পালিয়ে যায়। এতে রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা আব্দুর রশিদকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে খুন করে।
অপহৃত প্রিয়জেনের মৃতদেহ উদ্ধারের খবর জানার পর স্বজনদের ঈদের আনন্দ পরিণত হয় শোকে।
অপরদিকে গেল ২৪ মে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালীর গহীন অরণ্যে মাটি খুড়ে ২৫দিন আগে অপহৃত যুবক শাহেদের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বজনদের অভিযোগ, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের মিনাবাজার এলাকার মোহাম্মদ হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ শাহেদকে অপহরণ করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা।
উল্লেখ্য, গত ২৯শে এপ্রিল রাতে মিনাবাজারের পাহাড়ী এলাকা থেকে ধান ক্ষেত পাহারা দেওয়ার সময় শাহেদসহ ৩ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গা হাকিম ডাকাতের বাহিনী। এর পর ডাকাত দল তাদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা দাবী করে আসে। কিন্তু টাকা না পাওয়ায় দুইদিন পর অপহৃতদের মধ্যে আক্তারুল্লাহ নামে এক যুবককে হত্যা করে হোয়াইক্যংয়ের উনচিপ্রাং এলাকায় পাহাড়ের কাছে লাশ ফেলে দেয় হাকিম বাহিনী। আক্তারুল্লাহকে হত্যার পর ফোন করে হত্যার কথা স্বীকার করে শাহেদ সহ দুইজনের জন্য ২০ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবী করতে থাকে হাকিম।



এসময় অপহৃতদের উদ্ধারে মানববন্ধন পালন করে স্থানীয়রা।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন কয়েকদফা পাহাড়ে অভিযান চালালেও অপহৃত কাউকে উদ্ধার কিংবা ডাকাত দলের কাউকে আটক করতে পারেনি। একপর্যায়ে ২৪শে মে রোববার সকালে অপহৃত ইদ্রিস পালিয়ে বাঁচে। সে জানায় শাহেদকে হত্যা করে পাহাড়ে পুঁতে ফেলে ডাকাতরা। পরে তার দেখানো পথে অভিযান চালিয়ে রোববার বিকেলে নিহত শাহেদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ীর ইনচার্জ মশিউর রহমান জানান, পালংখালীর গহীন পাহাড়ে কুইচ্ছার জোড়া থেকে নিহতে লাশ উদ্ধার করা হয়। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীর পর নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। চারদিন আগে তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিতে পুতে ফেলে ডাকাত দল।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী দু’জনের লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, রোহিঙ্গা ডাকাতদের হাতে একের পর এক নির্মম হত্যাকান্ডে জনগন আতংকিত ও ক্ষুব্ধ ৷ তিনি প্রশাসনের জরুরী হস্তক্ষেপ চান।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ জানান, হাকিম ডাকাতের আস্তানা থেকে একজন জীবিত ফিরে আসা ও লাশ উদ্ধারসহ সব কিছু নিয়ে পুলিশ হাকিমের অবস্থান চিহ্নিত করতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আজকেও অপহৃত আরো একজনের লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে। ডাকাতদের ধরতে অভিযান চলছে বলেও দাবি করেন তিনি।



এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ডাকাত দলের কাছ থেকে যুবক ইদ্রিসের পালিয়ে আসা ও হাকিমের রাখাইনের পাড়ি জমানোর বিবরন অনেকের কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। তাদের ধারনা ডাকাত দলের সাথে তার যোগসাজস থাকতে পারে। সে দশ বারো বছর আগে মিয়ানমার থেকে আসা পুরোনো রোহিঙ্গা হওয়ায় সন্দেহ আরো বাড়ছে বলে জানান ওই সূত্র।
গেল ৪/৫ বছর ধরেই টেকনাফ-উখিয়ার গহীন পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে অপহরণ, খুনসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সশস্ত্র হাকিম ডাকাত। নিজেকে সে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আল ইয়াকিনের সদস্য হিসেবে বেশ কয়েকদফা ভিডিও বার্তাও ছেড়েছে। এর আগে তাকে গ্রেফতারে পাহাড়ে ড্রোন ও হেলিকপ্টার অভিযান চালিয়েছিল র্যাব। এছাড়া পুলিশ বিভিন্ন সময় হাকিমের আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে বন্দুকযুদ্ধে হাকিমের দুই ভাই ও স্ত্রী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
এতো কিছুর পরও সব অভিযান ব্যর্থ করে দিয়ে বহাল তবিয়তে খুন-অপহরণসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে এই হাকিম ডাকাত।