|| সারাবেলা প্রতিনিধি, ফটিকছড়ি(চট্টগ্রাম) ||
প্রতিষ্ঠার এক দশক পর কেন্দ্রীয় সম্মেলন (কাউন্সিল) আয়োজনের মধ্যদিয়ে আবারো আলোচনায় দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মত রোববার (১৫ নভেম্বর) সংগঠনটির সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায় এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এদিন সকাল ১০টা থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসা মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে বিকাল পর্যন্ত কাউন্সিল চলবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনটির সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে ঘিরে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। হেফাজত ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফি চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে আমিরের পদটি শূণ্য হয়। মূলত সে থেকেই প্রতিষ্ঠার দশ বছর পর সংগঠনটির কাউন্সিলের আলোচনা শুরু হয়।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় সম্মেলন (কাউন্সিল) উপলক্ষে রোববার সারাদেশ থেকে কওমি অঙ্গনের শীর্ষ আলেমরা হাটহাজারী মাদ্রাসায় উপস্থিত হওয়ার কথা রয়েছে। হেফাজতের প্রায় সাড়ে ৩’শ জন কেন্দ্রীয় শীর্ষ মুরুব্বিই ঠিক করবেন কে প্রয়াত আমির আহমদ শফির স্থলাভিষিক্ত হবেন। তবে আজকের এ কাউন্সিলে সংগঠনটির নায়েবে আমীর আব্দুল কুদ্দুস ফরিদাবাদি, যুগ্ম-মহাসচিব মাইনুদ্দীন রুহী, প্রচার সম্পাদক শফীপুত্র আনাস মাদানীসহ বর্তমান কমিটির বেশ কয়েকজন নেতাকে আমন্ত্রণ করা হয়নি বলে জানা গেছে। এরমাধ্যমে প্রয়াত আমির আল্লামা শফীর অনুসারীদের বাদ দিয়েই সংগঠনটির এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এদিকে, হেফাজতে ইসলামের কাউন্সিলে মূল নেতৃত্ব আমীর ও মহাসচিব পদে কারা আসছেন তা নিয়ে সংগঠনটির কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝে নানা কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী আলোচিত এ ধর্মীয় সংগঠনটির নেতৃত্বে কারা আসছেন তা নিয়ে সর্বত্র চলছে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কেন্দ্রীয় হেফাজত নেতা বলেন, কওমি অঙ্গন ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ আবেগস্থল হেফাজতে ইসলাম। আমাদের একটাই চাওয়া এ সংগঠনের আমীর ও মহাসচিবসহ সব পদে সবার গ্রহণযোগ্য এবং রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ নেই এমন ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা হোক। সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলামের আমীর পদে বর্তমান সিনিয়র নায়েবে আমীর মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, নায়েবে আমির নূর হোসাইন কাসেমী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম আলোচনায় থাকলেও বর্তমান সময়ে কওমী অঙ্গনে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে জুনায়েদ বাবুনগরীই প্রয়াত আমীর আল্লামা শফীর স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন।
এছাড়া, প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে হেফাজতে ইসলামের মূল নেতৃত্ব আমীর-মহাসচিব চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত হলেও এবার প্রধান এ দুই পদে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে সমন্বয় করে মূল নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ করার জোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা। সে হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে আমীর নির্বাচিত করা হলে মহাসচিব করা হবে ঢাকার কাউকে। এক্ষেত্রে হেফাজতের বর্তমান নায়েবে আমীর নূর হোসাইন কাসেমী ও ঢাকা মহানগরীর নেতা নূরুল ইসলাম জিহাদীর নাম মহাসচিব পদে আলোচনার শীর্ষে। তন্মধ্যে নূর হোসাইন কাসেমী ২০ দলীয় জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব। হেফাজতের গঠনতন্ত্র মতে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি সংগঠনের মূল নেতৃত্বে আসার সুযোগ নেই। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত পন্থীরাসহ একটি গোষ্ঠী কাসেমীকে হেফাজতের মহাসচিব করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি একাধিক সূত্রের। এসব কারণে সংগঠনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ পদে রাজনীতিক নূর হোসাইন কাসেমীকে নিয়ে তীব্র আপত্তি দেখাচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের অধিকাংশ নেতাকর্মী।
অন্যদিকে, নূরুল ইসলাম জিহাদি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। তিনি তাহাফ্ফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের মহাসচিব। হেফাজতের প্রয়াত আমীর আল্লামা শফীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জিহাদি দীর্ঘদিন ধরে হাটহাজারী মাদ্রাসার নীতিনির্ধারণী কমিটি মজলিসে শূরার অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একইসাথে হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ইতোপূর্বে কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন, সম্প্রতি হাটহাজারী মাদ্রাসায় সৃষ্ট জটিলতা সমাধানসহ নানা বিষয়ে জোড়ালো ভূমিকার কারণে দূরদর্শী নেতৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে কওমী অঙ্গনে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন নুরুল ইসলাম জিহাদি। এসব কারণে হেফাজতের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা ও সাধারণ নেতাকর্মীর প্রথম পছন্দ তিনি। সবমিলিয়ে শেষ পর্যন্ত জিহাদিই হেফাজতের মহাসচিব নির্বাচিত হতে পারেন বলে মনে করছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে ব্যতিক্রম ঘটলে পূর্বের ধারাবাহিকতায় আমীর-মহাসচিব দু’জনই চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচন করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ফটিকছড়ির জামিয়া ওবাইদিয়া নানুনুর মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরীকে মহাসচিব করা হতে পারে বলে সূত্রে জানাগেছে।
এছাড়া, রোববার অনুষ্ঠেয় কাউন্সিলে সংগঠনটির শুরুর দিকে নানা কারণে সরে দাঁড়ানো কওমি অঙ্গনের শীর্ষ বেশ কয়েকজন আলেমকে ফের যুক্ত করা হচ্ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। এদের মধ্যে পটিয়া মাদ্রাসার আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী, চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফ মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী ও বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি আরশাদ রহমানি অন্যতম বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারী দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসা মিলনায়তনে দেশের শীর্ষ সব কওমী আলেমের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ওলামা সম্মেলনে গঠিত হয়েছিল কওমি আক্বীদা ভিত্তিক অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠন হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ। যদিওবা পরে অরাজনৈতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা এ সংগঠনটি দেশের রাজনীতিতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। ২০১০ সালের ওই সম্মেলনে প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমীর মনোনীত হন। শুরুতে চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফ মাদ্রাসার পরিচালক সুলতান যওক নদভীকে মহাসচিব করা হলেও পরে এ দায়িত্ব দেয়া হয় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে। নবী-রাসূলের অবমাননা, নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি বিরোধিতার মধ্যদিয়ে হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ হলেও ২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবিতে ৫ মে শাপলা চত্বর অবরোধের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক এ সংগঠনটি বিশ^জুড়ে আলোচনায় আসে।