|| সারাবেলা প্রতিবেদন , চট্টগ্রাম||
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস এখন পুলিশের হেফাজতে। তাকে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার নিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে হস্তান্তর করার কথা। পুলিশ সূত্র বলছে, এসপির কাছে হস্তান্তরের পর তার কাছ থেকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে।
এর আগে বুধবার ভাইকে খুন করা হয়েছে দাবি করে কক্সবাজারের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রদীপ কুমার দাস এবং বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত সহ নয়জন পুলিশ সদস্যকে আসামী করে হত্যা মামলা করেন নিহত মেজর (অব.) সিনহা রাশেদের বোন শারমিন শাহরিয়ার। মামলার তদন্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে র্যাবকে।
বুধবার মামলার পরপরই ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়। এরআগে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় নয় জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন আদালত। বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফ মডেল থানায় নিয়মিত হত্যা মামলা দায়ের হওয়ার পরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। মামলা নম্বর সিআর: ৯৪/২০২০ (টেকনাফ)। দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলাটি রুজু করা হয়েছে।
গত ১লা অগাস্ট টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। এই ঘটনায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা আসতে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বুধবার কক্সবাজারে গিয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন সেনাপ্রধান আব্দুল আজিজ আহমেদ ও পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ।
রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী উভয়ই এই হত্যাকান্ডকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবেই দেখছে বলে জানানো হয় জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। এবং বিষয়টি নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে কোন ধরণের ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই বলেও দাবি করেন রাষ্ট্রীয় দুই বাহিনীর প্রধান। এছাড়া দুই বাহিনীর সম্পর্কে পারস্পরিক আস্থা অটুট রাখার ঘোষণাও আসে সেনা-পুলিশের যৌথ সংবাদ সম্মেলন থেকে।
এদিকে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, “চট্টগ্রামের দামপাড়া বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে এসেছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। তাকে এখন পুলিশ হেফাজতে কক্সবাজারে নেওয়া হচ্ছে। তিনি যেহেতু মামলার আসমি, তিনি সেখানে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন।”
টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় তার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস যে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন, তাতে দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশকে। শারমিন বুধবার সকালে টেকনাফের বিচারিক হাকিম আদালতে মোট ৯ জনকে আসামি করে ওই মামলা করার পর বিকালে টেকনাফ থানা থেকে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে প্রত্যাহার করা হয়।
জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ বুধবার হত্যা মামলাটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মামলার তদন্তভার দেন র্যাবকে। এরপর বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় টেকনাফ থানায় মামলাটি নথিভুক্ত করা হয় বলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বিএম মাসুদ হোসেন জানান।
তবে র্যাব বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত মামলার নথিপত্র বুঝে পায়নি জানিয়ে কক্সবাজারের র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, “দায়িত্ব বুঝে পেলে নিয়ম অনুযায়ী আমরা কাজ শুরু করব।”
মামলার ১ নম্বর আসামি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলিসহ ২০ পুলিশ সদস্যকে আগেই প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয়। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে যে, ওসি প্রদীপের ফোনে পাওয়া নির্দেশে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই লিয়াকত আলি গুলি করেছিলেন সিনহাকে। মামলার বাকি সাত আসামি হলেন- টেকনাফ থানার এসআই দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল এবং কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।
প্রসঙ্গত দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরির জন্য গেল প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। আরও তিন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি উঠেছিলেন নীলিমা রিসোর্টে।
গত ৩১শে জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়ে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। এই ঘটনায় পুলিশ মামলাও করে।
তবে পুলিশের এই ভাষ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বোনের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় ‘ইচ্ছাকৃত নরহত্যা’, ২০১ ধারায় আলামত নষ্ট ও মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি এবং ৩৪ ধারায় পরস্পর ‘সাধারণ অভিপ্রায়ে’ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ ধারার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ঘটনার সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে (২১) মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে। ঘটনার দিনই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলায় তাকেও আসামি করা হয়। এছাড়া আটজন স্থানীয় বাসিন্দা এবং আইয়ুব আলী নামে একজন সার্জেন্টকে সাক্ষী করা হয়েছে এ মামলায়।
সিনহা নিহতের ঘটনায় জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের সমিতি রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)।
একই দিন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে গিয়ে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, এই ঘটনায় যে এই ঘটনায় দায়ী হিসেবে যে বা যারা চিহ্নিত হবে, তারাই শাস্তি পাবে। এর দায় বাহিনীর উপর পড়বে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মঙ্গলবার সিনহার মা নাসিমা আখতারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেন।