|| সারাবেলা প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ||
বর্ষা এলেই বাড়ে পাহাড়ধসের ঝুঁকি। তারপরও বাস্তুচ্যূত লাখো মানুষের বাস চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে। জেলার শুধু রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাহাড়গুলোতেই বাস করছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। করোনা দূর্যোগ সামাল দিতে গিয়ে চলতি বর্ষায় এসব পরিবারকে ঝুঁকি থেকে সরানোর এখনো কোন উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। তাই যে কোনো সময় বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।
প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড় ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটলেও, উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে বসত বন্ধ করা যাচ্ছে না। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় নয় হাজার একর সরকারি ও ১৫ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে। এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রায় ১০ হাজার বসতঘর।
চন্দ্রঘোনার বনগ্রামের বার মহল্লা সর্দার মো. আবু মনছুর জানান, বনগ্রামের শ’য়েরও বেশী পাহাড়ের ঢাল কেটে নির্মাণ করা এসব বসতিতে মৃত্যুঝুঁকি জেনেও বাস করছে প্রায় দেড় হাজার পরিবার। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় এসব বসতঘর নির্মাণের সুযোগ করে দেন।
পারুয়া ইউপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবদুল ছত্তার বলেন, ‘জঙ্গল পারুয়া গ্রামের পাহাড়ে প্রায় ৬’শ পরিবার বাস করছে। এই বর্ষায় তারা পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে মারা যান জঙ্গল পারুয়া গ্রামে আবুল খায়ের।’
পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল সিরাজুল ইসলাম জানান, পৌর এলাকার ইছাখালি, গুচ্ছগ্রাম, জাকিরাবাদ, কাদের নগর ও নোয়াগাঁওয়ের পাহাড়ে বাস করছে প্রায় হাজার পরিবার। এদের অনেকে পাহাড়ের চূড়া কেটে নির্মাণ করেছে বসত। গেল বছরগুলোতে এসব পাহাড়ে ঘটেছে বেশ কয়েক দফা পাহাড়ধস। এতে মারা গেছে বেশ কয়েকজন। আহতও হয়েছে অনেক মানুষ।
পৌর এলাকার ইছাখালী মোহাম্মদপুর পাহাড়ে বসতঘর নির্মাণ করে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অর্ধশতাধিক পরিবার। সেখানকার বয়সী বাসিন্দা আয়েশা খাতুন জানান, মরিয়মনগর ইউনিয়নের বালুগোট্টায় কর্ণফুলী নদীতে ভিটেবাড়ি হারিয়ে ২০০৯ সালে এ পাহাড়ে বসতঘর নির্মাণ করেন তিনি। কিন্তু গত ২০১১ সালের বর্ষায় পাহাড়ের মাটি ধসে বসতঘরের নিচে চাপা পড়ে তাঁর চার বছরের শিশু আবদুল কাদেরের কোমর ভেঙে যায়।
গত ২০১৭ সালের ১৩ই জুন মঙ্গলবার রাতে পাহাড়ধসে মারা গেছে উপজেলার রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের দুই পরিবারের ২২ জন। এছাড়াও জেলার আরো ৫টি পাহাড়ে ধসের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ৩০শে ডিসেম্বর দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর এলাকায় পাহাড় কাটার মাটি চাপা পড়ে মারা যায় এক শিশুসহ ৩ জন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের কমিউনিটি সেন্টার, জঙ্গল বেতাগি এলাকায় পাহাড় কেটে প্রভাবশালীরা মাটি বিক্রি করছে।
একইভাবে উপজেলার উত্তর রাঙ্গুনিয়ার ১ নম্বর রাজানগর, ১৩ নম্বর দক্ষিণ রাজানগরের মুহাম্মদপুর, বাইশ্যাের ডেবা, ১৪ নম্বর ইসলামপুরের মঘাছড়ি, রইস্যার ১৫ নম্বর লালানগরের চাঁদের টিলা, ছনখোলা বিল,পেইট্ট্যাঘোনা, আগুনিয়া চা বাগান, হোসনাবাদ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তাপুর, ফকিরারটিলা, ফুইট্ট্যােগোদা , পোমরা, কোদালা, পোমরা, পারুয়া, সরফভাটা, শিলক ও পদুয়া ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কেটে বসতঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছে ৪ হাজারেরও বেশি পরিবার।
এ প্রসঙ্গে বন বিভাগের রাঙ্গুনিয়া ইছামতি রেঞ্জ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীরা কোনো আইন মানে না। তাদের উচ্ছেদ করার পরও আবার বসতি গড়ে।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশ কেটে বসতঘর নির্মাণ না করার জন্য রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এবং বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। তাতেও পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ বন্ধ হয়নি। পাহাড়ে বসবাসকারী এতগুলো পরিবারকে পুনর্বাসন করাও সময়ের ব্যাপার।
এ অবস্থায় পাহাড়ধসের হাত থেকে বাসিন্দাদের বাঁচানোর ব্যাপারে প্রশাসন খুবই উদ্বিগ্ন। তবে পাহাড়ধসে হতাহতের ঘটনা এড়ানোর জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা।