।। সারাবেলা প্রতিবেদন, চট্টগ্রাম ।।
প্রদীপের সম্পদের আলোয় উজ্জ্বল ছিলেন চুমকি। হবেনইনা বা কেনো? তিনি যে প্রদীপের স্ত্রী। নিজের নাম ঢাকতে স্ত্রী চুমকিকে অবৈধ সম্পত্তির মালিকানা দিয়েছেন মেজর (অব:) সিনহা হত্যা মামলার আসামী টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ। দাপট হারানো ওসির এখন চারদিক দিয়ে বিপদ। এবার স্বামী প্রদীপের হস্তান্তরিত প্রায় চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় এক নম্বর আসামি হয়েছেন স্ত্রী চুমকি। ওসি প্রদীপ এ মামলায় দ্বিতীয় আসামি। তাকে গ্রেফতার দেখাতে এরইমধ্যে আদালতে আবেদন করেছে দুদক। আর তার স্ত্রী চুমকিকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে সংস্থাটি।
এদিকে চুমকি দেশে আছেন নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তা জানার চেষ্টা করছে গোয়েন্দারা।
অভিযুক্ত প্রদীপ কুমার দাশ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামের মৃত হরেন্দ্র লাল দাশের ছেলে।বরখাস্ত এই ওসিকে দুদকের মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করা হয়েছে এ তথ্য সোমবার নিশ্চিত করেন দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘দুদকের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখানোর জন্য গত বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) মহানগর সিনিয়র স্পেশাল দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমানের আদালতে আমরা আবেদন করেছিলাম। আদালত আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর আমাদের আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য করেছেন।’
মামলার এজাহারে অভিযোগ আনা হয়, চুমকি কারণ দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১৩,১৩,১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। এছাড়া তিন কোটি ৯৫,০৫,৬৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয়েছে, যা ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করে পরস্পরের যোগসাজসের মাধ্যমে হস্তান্তর ও স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ থেকে চুমকি কারণের কাছে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ পাঠানো হয়। ১২ মে তিনি সম্পদ বিবরণী দুদকে জমা দেন। সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারণ ৩,৬৬,৫১,৩০০ টাকা স্থাবর এবং ৪২,৮৪,৩৯৪ টাকার অস্থাবরসহ মোট ৪,০৯,৩৫,৬৯৪ টাকার সম্পদের তথ্য উল্লেখ করেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে চুমকি কারণের নামে ৩,৬৬,২৪,৪৭৫ টাকার স্থাবর এবং ৫৬,২৪,৩৯৪ টাকার অস্থাবরসহ মোট ৪,২২,৪৮,৮৬৯ টাকার সম্পদের হিসাব উঠে আসে। এ হিসেবে এজাহারে ১৩,১৩,১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সময়ে তিনি ২১,৭০,০০০ টাকা পারিবারিক ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় করেছেন। এ হিসেবে তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে, ৪,৪৪,১৮,৮৬৯ টাকা। কিন্তু দুদক অনুসন্ধানে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয় পেয়েছে ৪৯,১৩,২৩৪ টাকা। এক্ষেত্রে তার জ্ঞাত আয়ের উৎসবহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ হচ্ছে ৩,৯৫,০৫,৬৩৫ টাকা।
এ মামলায় ওসি প্রদীপের স্ত্রী চুমকি কারণের সম্পদের মালিক হওয়াটাও বেশ মআদার।দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে আসে এসেছে, ওসি প্রদীপের শ্বশুর তার মেয়ে চুমকি কারণকে সাবরেজিস্ট্রি দলিল করে বাড়ি উপহার দিলেও তার অন্য সন্তান অর্থাৎ চুমকির অন্য ভাই-বোনদের কিছুই দেননি। দুদক খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, অন্য সন্তানদের দেওয়ার মতো আর কোনও সম্পদও ওসি প্রদীপের শ্বশুরের ছিল না। তাহলে এক মেয়েকে সব দিয়ে বাকিদের বঞ্চিত করার কী মানে হতে পারে? দুদক অনুসন্ধান করে দেখেছে, প্রকৃতপক্ষে শ্বশুরের নামে ওই বাড়িটি বানিয়েছিলেন ওসি প্রদীপ নিজেই। এরপর সেটি স্ত্রীর নামে লিখে নিয়ে ও শ্বশুরকে দিয়ে দলিল করিয়ে ভোগদখল করছিলেন তারাই। দুদকের ধারণা, নিজের অবৈধ সম্পদকে জায়েজ করতে শ্বশুরের সহযোগিতা নিয়েছেন ওসি প্রদীপ। আর সম্পদ মেয়ের নামে লিখে দেওয়া হচ্ছে জেনে তার শ্বশুর এতে সহযোগিতা করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
দুদক তাদের সংগ্রহ করা বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা করে আরও জানতে পেরেছে, চুমকি কারণ একজন গৃহিণী। তবে তিনি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথম আয়কর রিটার্ন জমা দেনে কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবে। এর পরবর্তী বছরগুলোতে চুমকি মাছের ব্যবসা ও বাড়ি ভাড়া থেকে আয় দেখিয়ে রিটার্ন দাখিল করে আসছেন। এই নারী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও পরবর্তী অর্থবছরে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূলধন দেখিয়েছেন। তবে অনুসন্ধানে নেমে তার কমিশন ব্যবসার কোনও খোঁজ পায়নি দুদক। এছাড়াও কমিশন ব্যবসার লাইসেন্স, ব্যাংকে লেনদেনের কোনও প্রমাণ এবং সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ অনুমোদন দেখাতে পারেননি চুমকি কারণ।
দুদক থেকে বলা হয়, সম্পদ বিবরণীতে চুমকি কারণ মাছের ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন। না। ২০০২ সাল থেকে মাছের ব্যবসা থেকে আয় করার তথ্য দিলেও আয়কর রিটার্নে তিনি সেটা উল্লেখ করেননি। তবে দুদক অনুসন্ধান করে দেখেছে, চুমকি কারণ গৃহিণী এবং তার স্বামী ১৯৯৫ সালে সরকারি চাকরিতে এসআই পদে যোগ দেওয়ায় তাদের ২০০২ সালে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা সঞ্চিত থাকার সুযোগ নেই। অথচ এই পরিমাণ টাকা দিয়েই বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর সারোয়াতলী গ্রামে পাঁচটি পুকুর ইজারা বরাদ্দ নেওয়ার তথ্য দিয়েছেন চুমকি কারণ। ফলে এসব তথ্য যে ভুয়া এবং ওসি প্রদীপের অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থকে সাদা করার চেষ্টা তা দুদকের অনুসন্ধানে বোঝা গেছে।
এদিকে মামলার প্রধান আসামি চুমকি কারণ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে এমন আশঙ্কাও করছে দুদক। এ কারণে তার দেশত্যাগ ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে সোমবার (৩১ আগস্ট) পুলিশ সদর দফতরে চিঠি পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের ওই আইনজীবী। তিনি জানান, একই মামলায় তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিদেশযাত্রা বন্ধেও ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত ২৩ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারণের বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দীন। দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।
এ মামলার এজাহারে চুমকি কারণকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তিনি স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরপূর্বক একে অপরের সহযোগিতায় ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, ‘চুমকি কারণের কাছে যখন সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, একইসঙ্গে প্রদীপ কুমার দাশকেও দেওয়া হয়েছিল। প্রদীপও সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছেন। সেই বিবরণী যাচাই-বাছাই চলছে। এ মামলা শুধু চুমকির সম্পদ বিবরণীর ভিত্তিতে করা হয়েছে।’
তবে মামলা দায়ের হলেও চুমকি কারণের খোঁজ নেই। একাধিক গণমাধ্যম চেষ্টা করেও তার সাক্ষাৎ পায়নি। মামলাটিতে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে তিনি আত্মগোপনে গেছেন নাকি নজরদারিতে আছেন নাকি দেশ ছেড়েছেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
এদিকে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, মামলা দায়েরের পর চট্টগ্রাম শহরের সদরঘাটে এক স্বজনের বাসায় কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন চুমকি কারণ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সে তথ্য জানলেও এরপর থেকে তার আর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন নাকি অন্য স্বজনদের বাসায় লুকিয়ে আছেন সে বিষয়ে এ মুহূর্তে নিশ্চিত কোনও তথ্য নেই।
৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওই ঘটনায় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস গত ৫ আগস্ট কক্সবাজারের হাকিম আদালতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক এসআই লিয়াকত, এসআই নন্দলাল রক্ষিতসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আদালত পরদিন মামলাটি গ্রহণের জন্য টেকনাফ থানাকে নির্দেশ দেয়। একইদিনে অভিযুক্ত ৭ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। ৬ আগস্ট আদালতে আত্মসমর্পণে গেলে অভিযুক্ত ৭ পুলিশ কর্মকর্তার জামিন না মঞ্জুর করে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন আদালত। এরপর থেকে মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। এ মামলায় আসামিরা বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছে।