পাহাড়ে মিশ্র বাগানে দিন বদলের স্বপ্ন দেখছেন সিরাজ

|| এম, মতিন, চট্টগ্রাম থেকে ||

সিরাজুল করিম বিপ্লব। পেশায় একজন ব্যবসায়ী ও সাবেক ছাত্রনেতা। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত। ব্যবসা আর রাজনীতির পাশাপাশি তিনি নিজ উদ্যোগে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের জাইতছড়ির পাহাড়ে বানিজ্যিকভাবে গড়ে তুলেছেন বিষ মুক্ত বিভিন্ন জাতের মিশ্র ফলজ বাগান। 

সিরাজুল করিম বিপ্লব রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫ নং লালানগর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের আকবর সিকদার  পাড়া গ্রামের মৃত আবদুস সত্তারের পুত্র। পেশায় ব্যবসা ও রাজনীতিবিদ হলেও কৃষি খামারের প্রতি রয়েছে তার প্রবল আগ্রহ ও অদম্য চেষ্টা। তারই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ সাড়ে ৩ বছর ধরে ১০ একর পাহাড়ি জমির উপরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গড়ে তোলেন এই বিশাল ফলজ বাগান। তার এই কেমিক্যাল মুক্ত মিশ্র ফলজ বাগান স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছেন। বাজারেও তার ফলের চাহিদা ব্যাপক। বর্তমানে তার বাগানে ৩০ প্রজাতির ফলজ গাছ রয়েছে।

সরেজমিনে বাগান ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রাম -কাপ্তাই সড়ক থেকে ৮ কিলোমিটার ভেতরে গড়ে উঠা সারি সারি মাল্টা, আম, লিচু, পেয়ারা ও পেঁপে গাছ। বাগানের ৫ একর জমিতে কেবল মাল্টা (বারি-১) আর আমগাছ লাগিয়েছেন তিনি। ২ একর জমিতে করেছেন বনজ বাগান। আমের বাগানে আম্রপালি, রাংগোয়াই, মল্লিকা, হাঁড়িভাঙাসহ দেশি-বিদেশি নানা জাতের আম রয়েছে। তবে আম্রপালি ও রাংগোয়াই বেশি। বাগানের পশ্চিম পাশে ৩ একর জমিতে মিশ্র ফলের বাগান। সেখানে আপেলকুল, কমলা, জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, আনারস, আমলকি, জামরুল, আতা, ডালিম, নাশপাতি, চালতা, কামরাঙ্গা, জলপাই, লেবু, পেঁপে, সাজিনা। এছাড়া আংগুর, থাই বাতাবী লেবু, চায়না কমলা, চায়না লিচু, চায়না পেয়ারা। মশলার মধ্যে সাদা এলাচ, তেজপাতা, পোলাও পাতা। ঔষধি গাছের মধ্যে কালোমেঘ, তুলসি, আলোভেরাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি গাছ তার বাগানে রয়েছে।

কোন কোন গাছে ফুল ফুটেছে। আবার কিছু গাছে ফল আসতে শুরু করেছে। ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক বাগান পরিস্কারের কাজ করছেন। বাগানে সেচের জন্য পাইপ বসানো হয়েছে। পাইপ থেকে নালীর সাহায্যে পাহাড়ের উচু জায়গায় পানির লাইন নিয়ে আসা হয়েছে। বাগানের মাঝখানে বাঁধ দিয়ে ছোট লেক তৈরী করা হয়েছে। সেখান থেকে শুকনো মৌসুমে বাগানে পানি দেওয়া হয়। এ রকম একটি পরিকল্পিত বাগান রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় এলাকায় আর একটিও নেই বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

সিরাজুল করিম বিপ্লব বলেন, আমি ২০১৬ সালে পেয়ারা, কাঠগাছ ও রেডলেডি পেঁপে ও রাংগোয়াই আম দিয়ে বাগান শুরু করেছিলাম। ২ বছর পর গাছ ও পেঁপে বিক্রি করে যা আয় করেছি সেই টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ চারা রোপনের কাজ, বাগান পরিষ্কার করা ও সেচের পাইপ লাইন স্থাপন কাজে বিনিয়োগ করেছি। আমার অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। আমি বৃহৎ মিশ্র প্রজাতী ও ঔষধী ফলের বাগান করার কাজ হাতে নিয়েছি। জমি লীজ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই আমার বাগানটি হবে জীবন্ত সংগ্রহ শালা। আমি দেশী-বিদেশী উন্নত ফলের চারা উৎপাদন করে স্বল্প মূল্যে চাষীদের মাঝে ছড়িয়ে দেব। সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে বাজারে দেশীয় ফলের অভাব দেখা যায়। তখন বিদেশী ফলের উপর নির্ভরশীল থাকে ফল বাজার। আমি চাচ্ছি, সারা বছর দেশীয় ফল বাজার সয়লাব করবে এবং বিদেশী ফলের উপর যেন নির্ভরশীল না হতে হয়। আমি বিদেশী ফলই দেশে চাষ করে বাজারে বিদেশী ফলের সরবরাহ বাড়াব। আমাদের যেন আর বিদেশ থেকে ফল আমদানী না করতে হয়, আমরা যেন দেশের ফলই বিদেশে রপ্তানী করতে পারি।’

মাল্টা মিষ্টি ও হালকা টক জাতীয় সু-স্বাদের নানা পুষ্টিগুণে ভরা এ ফল। কলবি মাল্টা গাছ লাগানোর এক বছরের মধ্যে ফল আসা শুরু করে। ৪ মাসের মধ্যে তা খাওয়ার উপযোগী হয়। গাছের সঠিক পরিচর্যা করলে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ফল ১০০-১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

এ সব ফল চাষ করতে প্রতি খুটিতে জৈব সার দিতে হয় ২ কেজি, গবর সার দিতে হয় ১৫ কেজি। চারা মাটির সাথে লেগে গেলে পটাশ, ইউরিয়া, জিপসাম সহ বুরণ সার দিতে হয় পরিমান মত বলে জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, বাগানের প্রধান সমস্যা হলো যাতায়াতের সমস্যা। উপজেলার সাথে যোগাযোগের একমাত্র সংযোগ সড়ক হচ্ছে ‘আকবর সিকদার পাড়া’ সড়ক। বছরের পর বছর রাস্তাটি বেহাল অবস্থায় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বার বার যোগাযোগ করার পরও রাস্তাটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। রাস্তার বেহাল দশার কারণে পাহাড়ে উৎপাদিত ফসল ক্রয় করতে বেপারিরা আসতে পারে না। অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে সঠিক সময়ে বাজারজাতের অভাবে প্রতি বছর এখানকার উৎপাদিত কোটি টাকার ফলমূল তরিতরকারি আদা-হলুদ পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। যার কারণে রাঙ্গুনিয়ায় কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকলেও লাভের মুখ দেখছে না কৃষকরা। দ্রুত রাস্তাটি সংস্কার করা না হলে কৃষকেরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া এখানে বসাবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষ রয়েছে। এখান থেকে চিকিৎসা নিতে উপজেলা সদরে যাওয়ার পথে অসুস্থ মানুষ এবং গর্ভবতী মহিলাদের ভোগান্তির সীমা থাকে না।

এ বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শহিদুজ্জান শাহেদ বলেন, ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলাটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল। এখানকার দুই তৃতীয়াংশ জুঁড়ে রয়েছে বিশাল পাহাড়ী এলাকা। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভূমি, অপরদিকে অত্র অঞ্চলের পাহাড়ি মাটির প্রতি ইঞ্চি সোনার মত খাঁটি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক একর জমিতে আম, ড্রাগন, মালটা, কমলা, লেবু, পেয়ারাসহ শতাধিক প্রজাতীর মৌসুমী ফসলের চাষ ব্যাক্তি উদ্দ্যেগে শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই তারা বাগানের ফল বিক্রি শুরুও করে দিয়েছেন। প্রচুর লাভবান হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকরা। আমরা তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। আশা করি অল্প দিনেই অত্র অঞ্চলটি কৃষি জোন হিসাবে দেশে ও বিদেশে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হবে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন