|| মো: রবিউল ইসলাম খান, লক্ষ্মীপুর থেকে ||
লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরের উপকূলীয় চরাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া হোগলা পাতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। নতুন নতুন চরগুলোতে নির্বিচারে কর্তন ও অপরিকল্পিতভাবে ফসলের চাষাবাদের কারণে পাতার উৎপাদন দিন দিনই হ্রাস পাচ্ছে বলে কৃষি সংশ্লিষ্টদের অভিমত। অন্যদিকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় পাতাটির দ্বারা তৈরি নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর বাজার মূল্যও এখন বেশ চড়া।
উপজেলার উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরবংশী ও রায়পুর ইউনিয়ন ঘুরে জানা যায়, মেঘনায় নতুন নতুন জেগে উঠা চরগুলোতে ১৫/১৬ বছর পূর্বেও প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর হোগলা পাতার জন্ম হতো। চরাঞ্চলের শত শত লোক হোগলা পাতার ফুল থেকে ঝরানো হোগল গুড়া ও পাতা সংগ্রহ করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। চরের পাতার নির্দিষ্ট কোনো মালিকানা না থাকায় যে যেভাবে পেরেছে নির্বিচারে কর্তন করে নিয়েছে। অনেকে আগুন ধরিয়ে জায়গা খালি করে সেখানে ফসলের চাষাবাদও করেছে। এ কারণে এবং নতুন চর না জাগার কারণে এ অঞ্চলে এখন হোগলা পাতা দুস্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি স্থানে টুকরো টুকরো পাতাবন দেখা গেলেও নেই আগের মতো।
জালিয়ার চরের কৃষক রফিক দেওয়ান বলেন, এক যুগ আগেও গ্রামের প্রত্যেকের ঘরেই হোগলার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্থতা দেখা যেতো। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে মক্তব, মসজিদ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতো হোগলা পাতার তৈরি হোগলা বা চাটাই (পাটি)। বিশেষ করে গ্রামের সকল পেশার মানুষ খাওয়া, নামাজ ও ঘুমানোর কাজে এর ব্যবহার করতো বেশি। বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় তীব্র গরমে মানুষের হোগলা পাতার হাতপাখা ছিল নিত্য দিনের সঙ্গী। পাতার সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখন সে স্থানটি দখল করে নিচ্ছে প্লাষ্টিকের তৈরি মাদুর, পাখা।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, হোগল পাতা নামক এ জলজ উদ্ভিদটি উপকূলীয় অঞ্চলের এটেঁল মাটিতে জন্মে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে জন্মে থাকে এ উদ্ভিদ। নদীর, খাল ও ঝিলের পাড়ে হালকা জলাবদ্ধ স্থানে বেশি দেখা যায়। লম্বায় প্রায় ৫ থেকে ১২ ফুট হয়। যখন এক থেকে ২ ইঞ্চি সারি সারি পাতার সমন্বয়ে বেড়ে ওঠে তখন সৃষ্টি হয় মনোমুগ্ধকর সবুজ পরিবেশ। বেড়ে ওঠার কিছুদিন পর এই জলজ উদ্ভিদের ফুলের জন্ম হয়। আর এই ফুল থেকে তৈরি হয় হলুদ রঙের এক প্রকার পাউডার যা পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবারের উপাদান হিসোবে ব্যবহৃত হয়। যাকে স্থানীয়ভাবে ‘হোগল গুড়া’ বলা হয়। সিজনের সময়ে প্রতি কেজির মূল্য শুরুতে ২৫০ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা থাকলেও ভরপুর সময়ে তা ৮০-১০০টাকায় বিক্রি হয়।
চর কাছিয়ার হোগল বিক্রেতা নুরভানু বেগম বলেন, আমার মতো স্বামীহারা বহু নারী হোগলা পাতা ও হোগল বিক্রি করে আগে সংসার চালাতাম। কিন্তু পাতাটির অভাবে আমরা আজ কর্মহীন হয়ে রাস্তার মাটি কাটার কাজে নেমেছি। হোগলা পাতা দিয়ে আগে ঘরের বেড়া, ধানসহ কৃষিপণ্য রাখার ঢোল, ক্ষেতে বেড়া, ঘরের ছাউনি ও ফসল রাখার টুকরি, মাছের আড়তদারদের খাচিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতো।
রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা হাসান ইমাম বলেন, হোগলা পাতার কৃষি ও অর্থনৈতিক গুন আছে। এটি আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের নদী ভাঙন প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এ কারণে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ উদ্ভিদটি পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করা গেলে কৃষি সেক্টরের উন্নয়নের মাইলফলকগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠতে পারে।
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরীন চৌধুরী বলেন, হোগলা পাতার অথনৈতিক মূল্য রয়েছে। চরগুলো বেদখল হয়ে হোগলাপাতার বন কেউ যদি ধ্বংস করে থাকে তবে বা খোঁজ-খবর নিয়ে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা পরিষদের আগামী বৈঠকে হোগলা পাতার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে এবং উপজেলা কৃষি বিভাগের সাথে আলোচনা করে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া এ পাতাটি রক্ষায় করণীয় নির্ধারণ করা হবে। একই সাথে কৃষি বিভাগের সাথে সমন্বয় করে এটির নতুন নতুন বনায়ন সৃষ্টি বা পরিত্যক্ত ভূমিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচারণা চালানো যেতে পারে।