|| এম. মতিন, চট্টগ্রাম থেকে ||
পুলিশের সহকারি পুলিশ পরিদর্শক কামরুল হাসান। চট্টগ্রামের সর্বত্রই এখন এক আলোচনার বিষয়। কামরুল হাসান সাড়ে ৩ বছর ধরে কাজ করছেন কোতয়ালি থানার বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়িতে। চাকরি শুরু করেছিলেন কনস্টেবল হিসেবে। প্রমোশন পেয়ে হয়েছেন সহকারি পুলিশ পরিদর্শক। দায়িত্বরত অবস্থায় পুলিশে পোশাক কিংবা সাধারণ পোশাকে মানুষকে হয়রানি, চাঁদাবাজি, মারধর এমনকি সহকর্মী ও উধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ নিয়েও বেশ আলোচিত তিনি।
চট্টগ্রামের ফুটপাত থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের কাছে যেন আতঙ্কের নাম এ এস আই কামরুল। নিজ এলাকায় নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। পুলিশের এই সদস্য এখন কোটিপতি পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।
সংবাদ সারাবেলা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এএসআই কামরুলের অবৈধ সম্পদ আর কর্মাকান্ডের তথ্য। যা চমকে দেওয়ার মত । অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠিানিক তদন্ত করলে মিলবে আরও চমকে দেওয়ার মত তথ্যউপাত্ত।
কামরুলের বাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির জেলার কাপ্তাই উপজেলার বাঙালহালিয়া ইউনিয়নে। এখন কাজ করছেন চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়িতে। পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেওয়ার তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নামে-বেনামে চট্টগ্রাম শহরসহ বাঙালহালিয়ায় গড়ে তোলেন অঢেল সম্পদ।
চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে ২০১৪ সালে ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এমবিএ পরীক্ষা দেওয়ার সময়ই তার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ সবার নজরে আসে। এর আগে ২০০৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ২০০৮-০৯ সালে কনস্টেবল এবং ২০১৬ সালের ২৯শে ডিসেম্বর তিনি সেসময়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সুনজরে থাকায় এএসআই হিসেবে পদোন্নতি পান। প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে কোতোয়ালী থানার বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়িতে কাজ করছেন তিনি।
পুলিশের চাকরি নেয়ার পর চাঁদাবাজির টাকায় নিজ এলাকা বাঙ্গালহালিয়া ৫০ লাখ টাকা খরচ করে গড়ে তুলেছেন ‘আমেনা মঞ্জিল’ নামে পাকা বাড়ি। বাড়িতে লাগিয়েছেন ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। ঘর সাজিয়েছেন দামি আসবাবপত্র দিয়ে। কিনেছেন ৯ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি। বেশ প্রভাব দেখিয়ে রাজকীয় জীবন যাপন করায় কামরুলের অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলতে সাহস পায় না।
এখানেই শেষ নয়, এ এস আই কামরুলের দাপটে তার ভাইপো বখাটে রানার হাত থেকে বাঁচতে গত বছরের ৩রা নভেম্বর বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের শফিপুর গ্রামের সাহেব আলীর মেয়ে ও বাঙ্গালহালিয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী শামীমা আক্তার বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠে। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে বখাটে রানাকে আসামি করে চন্দ্রঘোনা থানায় ৫ই নভেম্বর মামলা করা হয়। কিন্তু এএসআই কামরুলের প্রভাবে সে পার পেয়ে যায়। কামরুল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে ঘটনাটি মিমাংসা করেন।
শুধু তাই নয়, মানুষকে হয়রানি, চাঁদাবাজি, মারধর করার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এ এসআই কামরুলের বিরুদ্ধে। সবশেষ গেল বুধবার ২৯শে এপ্রিল বিকেলে মোহাদ্দিস মার্কেটের প্রার্থনা বস্ত্রালয় কর্মচারি গিরিধারী চৌধুরীকে বেধরক পেটান তিনি। এতে মারা যান গিরিধারী চৌধুরী। এই দোকান কর্মচারীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে টেরিবাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মচারী।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বুধবার বিকেলে গিরিধারী চৌধুরীসহ কয়েকজন কর্মচারী টেরিবাজারের প্রার্থনা বস্ত্রালয় থেকে বস্তায় ভরে কাপড় বের করছিলেন। কাপড়ের বস্তাগুলো রিকশায় তোলার সময় মার্কেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন তাদের জেরা করে। পরে সেখানে টহলরত এএসআই কামরুল এসে ৪ বস্তা কাপড়সহ গিরিধারী চৌধুরী ও ২ দোকান কর্মচারীকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিরিধারী চৌধুরীকে নির্যাতন করলে গিরিধারী চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়ির অভিযুক্ত এ এস আই কামরুল হাসান বলেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। হৃদরোগে মারা যাওয়া গিরিধারী চৌধুরীকে হত্যা বলে তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে।’
তবে সিএমপির উপ -পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে আটক হওয়ার পর পুলিশের টহল টিম গিরিধারী চৌধূরীকে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। দায়িত্বে অবহেলার দায়ে এক এ এস আই ও দুই কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও শনিবারেও তা দিতে পারেননি তদন্ত কমিটি। এমনকি গত ৩ দিনেও থানায় কোনো মামলাও নথিভুক্ত করা হয়নি।
প্রার্থনা বস্ত্রালয়ের কর্মচারী নিখিল দাশ জানান, প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার গিরিধারী চৌধুরী ও তাকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা। সেখানে পুলিশের এ এস আই কামরুল অনেকক্ষণ ধরে থাপ্পড় মারার পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান গিরিধারী। পরে হাসপাতালে মারা যান তিনি। বৃহস্পতিবার ৩০শে এপ্রিল বিকালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিরিধারীর ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়িতে মরদেহ দাহ করা হয়।
গিরিধারী চৌধুরীর ছেলে পরশ চৌধুরী বলেন, ‘আমি এই হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। পারিবারিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মামলা করবো।’
এদিকে এরআগে গত ১৭ই এপ্রিল টেরিবাজারের ৬ নম্বর গলির একটি মুড়ির গুদামে ঢুকে কর্মচারী অপু পালকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে এ এস আই কামরুলের বিরুদ্ধে। ওই মুড়ির গুদামের মালিক বলেন, ‘এ এস আই কামরুল তার কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। চাঁদা না দেওয়ায় তার গুদামে ঢুকে কর্মচারীকে বেধড়ক পেটায় কামরুল।’
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই করোনাকালে বন্ধ থাকা দোকান খোলা পেলেই ব্যবসায়ীদের পিটিয়ে আসছিলেন তিনি। কয়েকদিন আগেও বক্সিরহাটের বদর হোটেলের এক কর্মচারীকে পিটিয়েছেন কামরুল।
টেরিবাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এলাকার ফুটপাতে বসা দোকান ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দালালের মাধ্যমে চলে যায় বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়িতে। এছাড়াও বিভিন্ন অজুহাতে টাকা দাবি এবং আদালত থেকে কারো নামে থানার মাধ্যমে চিঠি এলে ওই ব্যক্তিকে ফাঁড়িতে নিয়ে জিম্মি করে পরিবার থেকে এ এস আই কামরুলের টাকা আদায় করার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, ফাঁড়ি এলাকার ফুটপাতে বসা প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ৩শ’, চটপটির দোকান থেকে ১ হাজার, ভাঙ্গারি দোকান থেকে মাসে ১৫শ’, ভ্যানে করে সবজি ও কাপড় বিক্রি করা ৪০টি ভ্যান থেকে দৈনিক ১শ’, ফাঁড়ি এলাকার টেম্পো স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ২শ’, বিভিন্ন হোটেল থেকে দৈনিক ১৫শ’ থেকে ২ হাজারসহ বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে টাকা আদায় করে থাকেন পুলিশের এ কর্মকর্তা।
অভিযোগ রয়েছে, টেরিবাজার এলাকা ও আশপাশের এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরাও তাকে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করে থাকেন। কোট বিল্ডিং এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদক ব্যবসায়ী জানান, প্রতি মাসের ২ তারিখের মধ্যে টাকা না পেলে আমাদের ডিস্টার্ব করেন পুলিশ ফাঁড়ির এ এস আই কামরুল হাসান। টাকা দিলে সব ঠিক থাকে। এক হোটেল ব্যবসায়ী জানান, আমরা আগে সরাসরি তাকে টাকা দিতাম, এখন তার এক লোক এসে টাকা নিয়ে যায়।
বক্সিরহাট এলাকার কয়েকজন ফুটপাত ব্যবসায়ী জানান, সবাই তাকে টাকা দেয়, তাই আমরাও দেই। টাকা দিলে ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারি, আর তা না হলে পুলিশ এসে সরিয়ে দেয়। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন কামরুল হাসান।
নাম না জানানোর শর্তে বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়ির এক সদস্য জানান, এখানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার কাছে একটি তালিকা আছে। কোথা থেকে টাকা আসবে এবং কবে আসবে। তালিকা অনুযায়ী টাকা সবসময়ই আসে, আর না আসলে ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ অভিযান চলে।