|| সারাবেলা প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ||
হেলাল খান। ডিপার্টমেন্টাল এসআই। বর্তমান পোস্টিং চট্টগ্রাম মহানগরীরর ডবলমুরিং থানায়। ইতোমধ্যেই ক্লোজড। অভিযোগ নিজের টাকায় পালিত সোর্সের মাধ্যমে আসামি ধরা-ছাড়ার বাণিজ্য, চিহ্নিত মাদক কারবারিদের মদদ দেওয়া, সাধারণ মানুষকে বিনা ওয়ারেন্টে আটক করে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে জেলে পাঠানোর ভয় দেখানো এবং পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া।
এসআই হেলালের এসব ‘অপরাধ’ এর ছায়াসঙ্গী ডবলমুরিং থানার আরো দুই এসআই রাজিব কান্তি দে ও সবুজ। সেইসঙ্গে তার নিজের সোর্সতো রয়েছেই। এসব ‘অপরাধ’ কাজে হেলার ব্যবহার করেন চট্টমেট্টো-হ সিরিয়ালের ৫১০৬৪৯ নম্বরের একটি সাদা নোহা গাড়ি।
দীর্ঘদিন ধরেই হেলাল ও তার সঙ্গীরা এসব ‘অপরাধ’ করে আসলেও সম্প্রতি মারুফ নামের এলাকার এক শিক্ষার্থি আত্মহত্যা(?) করায় স্বজন ও স্থানীয়দের অভিযোগের তীরটি এখন হেলাল ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধেই।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গেল ১৬ই জুলাই বৃহস্পতিবার ডবলমুরিংয়ের বাদামতলী বড় মসজিদ গলিতে দশম শ্রেনীর ছাত্র মারুফের ওপর ওপর চড়াও হয় হেলাল খানের দুই সোর্স। যাদের একজনের নাম কাশেম। এরা শুধু মারুফই নয়, মারুফকে উদ্ধারে এগিয়ে আসা মা রুবি আক্তার ও বোন নেহাকেও মারধরসহ শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করে। এরমধ্যে মাঝে ঘটনাস্থলে আসেন কন্সটেবল থেকে ডিপার্টমেন্টল প্রমোশন পেয়ে এসআই হওয়া হেলাল খান। সোর্সদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হেলাল খানও মারুফসহ তার মা বোনকে বেদম পেটায়। মারুফ পালাতে পারলেও পায়ে ধরেও হেলাল খানের কাছ থেকে নিস্তার পায়নি মারুফের মা বোন। তাদেরকে টেনে হিঁছড়ে নিজের সাদা রংয়ের নোহা গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যান।
ঘটনাস্থলে থাকা মারুফদের প্রতিবেশী রুবিনা আক্তার, রোকসানা আক্তার, জাহিদ ফজল, মামা তাহের ও নানা মুক্তিযোদ্ধা শফিক আহমেদ মুন্সী জানান, দুজন সোর্স গলিতে উঁকিঝুঁকি মারলে মারুফ তাদের লক্ষ্য করেন এবং তাদের সাথে মারুফের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোর্সদের সাথে মারুফের মারামারি হয়। এরমধ্যেই হেলাল খান সাদা পোশাকে এসে মারুফকে মারধর করেন এবং মারুফকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এতে মারুফের মা বোনসহ গলির লোকজন বাধা দিলে তাদেরকে মারধর করেন হেলাল খান।
জাহিদ ফজল নামে এক যুবক বলেন, ‘ঘটনার একপর্যায়ে মারুফ মাটিতে লুকিয়ে পড়লে এসআই হেলাল খান আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। মারুফকে ক্ষমা করতে ১ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে অপারগতা জানালে মারুফের মা বোনকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, মা বোনের এমন লাঞ্ছিত হওয়া ও থানায় নেওয়ার ঘটনায় পাশের বাড়ির করিম চাচার ঘরের ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করে ১৬ বছরের তরুণ সাদমান ইসলাম মারুফ। এর জন্য এস আই হেলাল ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের অভিযুক্ত করে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বাদামতলি এলাকার মানুষ।
বিক্ষুব্ধ মানুষগুলো বলছেন, মারুফের পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন এসআই হেলাল। যা দিতে না পারায় মারুফ ও তার মা বোনকে মারধর এবং তাদের থানায় নিয়ে যায় হেলাল খান। হয়তো এই অপমান সইতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছে মারুফ। তবে কেউ কেউ বলছেন, মারুফকে উপর্যুপরি মেরে পা ভেঙে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
মারুফের আত্মহত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই হেলাল খান শুক্রবার ১৭ই জুলাই সংবাদ সারাবেলাকে বলেন, ‘ঘটনাস্থলে যাওয়া মাত্র আমার ওপর মারুফ ও তার মা বোন হামলা চালায়। পরে থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আসলে তাদের ওপরেও চড়াও হয় তারা। একপর্যায়ে পরস্পরের মধ্যে হাতাহাতিতে মারুফের মা বোন আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাদেরকে চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরমধ্যে খবর পেয়ে মারুফ নামের ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। এখন পুরো বিষয়টি স্যারেরা দেখছেন। এ নিয়ে আমি আর কিছু বলতে চাইনা। আমি আর কিছু জানি না।’
সংবাদ সারাবেলার অনুসন্ধানে জানা যায়, উপ-পরিদর্শক (এসআই) হেলাল খান ডবলমুরিং থানার ‘সিভিল টিম’ নৈরাজ্যের মুল হোতা। যে টিমের মুল কাজ হলো, নিরহ মানুষকে ধরে গাড়িতে তুলে ইয়াবা দিয়ে মামলা দিবে বলে আটক করে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া। হেলাল খানের অন্যতম সহযোগী এসআই রাজীব কান্তি দে বায়েজিদ থানায় থাকতে তেল চুরির ঘটনায় ক্লোজড হন। এরআগেও বিদেশী এক নাগরিককে মদ দিয়ে ফাঁসানোর দায়ে একবার ক্লোজড হয়েছিলেন রাজিব কান্তি দে। আগ্রাবাদের হাজীপাড়ার আবুল সওদাগরের নাতি বাদশার ছেলে আরিফ কাছ থেকে ২০ পিস ইয়াবা জব্দের পর ৯০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে রাজীবের বিরুদ্ধে।
পুলিশের একটি সুত্র জানায়, হেলাল খান কন্সটেবল হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সেখান থেকে ডিপার্টমেন্টল প্রমোশন পেয়ে প্রথমে এএসআই এবং পরে এসআই পদ উন্নীত হন। দেড় বছর আগে ডবলমুরিং থেকে বদলি হয়ে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানায় যোগ দিয়েও বেশীদিন থাকতে পারেননি। কয়েকমাস পর ফের চলে আসেন ডবলমুরিং থানায়। সেই থেকে এসআই হেলাল খান ডবলমুরিং থানায় আছেন এবং ‘সিভিল টিম’ নিয়ে ডবলমুরিং দাপটের সঙ্গে ‘পুলিশিং’ করছেন।
মারুফের আত্মহত্যা ও পুরো ঘটনার বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাস ও পরিদর্শক (তদন্ত) জহির হোসেনকে পাওয়া যায়নি। সদীপ কুমার দাস অসুস্থতার দোহাই আর জহির হোসেন ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে কথা বলেননি সংবাদ সারাবেলার এই প্রতিনিধির সঙ্গে।
এদিকে মারুফের আত্মহত্যার পর এলাকাবাসীর বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় হেলাল খানকে সাময়িক ক্লোজড করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে ডবলমুরিংয় জোনের সহকারী কমিশিনার শ্রীমা চাকমা ও ডবলমুরিং থানার পরিদর্শক জহির হোসেনকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে ১২ ঘন্টার মধ্যে মারুফের আত্মহত্যা বিষয়ে তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন জমা দিতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য পুলিশের সহকারী কমিশনার শ্রীমা চাকমা বলেন, ‘ঘটনার রহস্য বের করার জন্যই আমাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা তদন্ত পূর্বক একটি প্রতিবেদন নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম জোন) স্যার বরাবর পাঠাবো। এরপর স্যারেরাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম জোন) ফারুক-উল হক বলেন, ‘তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে যদি কারো দোষত্রুটি পাওয়া যায় তাহলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ যদিওবা ঘটনার পরপরই এসআই হেলাল খানকে ক্লোজড করা হয়েছে।’
সরেজমিনে শুক্রবার ১৭ই জুলাই সকালে বাদামতলি মসজিদ গলিতে গিয়ে দেখা যায়, মারুফের মা বোন বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। কারো কোনো হুঁশ নেই। ছেলের শোকে কাতর হয়ে পাগল প্রায় মারুফের মা। আত্মীয় স্বজনরা মারুফের মা বোনকে সান্তনা দিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছেন। আত্মীয় স্বজন ও পাড়ার লোকজনও শোকস্তব্ধ।
সবার একটিই কথা। মারুফ কোনো খারাপ ছেলে ছিল না। পড়াশোনার পাশাপাশি লাকি প্লাজায় থাকা প্রতিবেশীর ক্রোকারিজের দোকানে কাজ করতো। তার সাথে কেন এমন হলো? এ দায় কে নেবে? মারুফের মা বোনের এখন কি হবে?