|| এম. মতিন, চট্টগ্রাম থেকে ||
চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে মা মাছ। প্রতি বছরের মত এবারও ডিম সংগ্রহের উৎসবে মেতেছে জেলেরা। রুই, কাতলা, মৃগেলের মত মিঠা পানির এসব মাছের পোনা হালদার পাড় থেকে চলে যাবে দেশের নানা প্রান্তে।
গেল বছর বৃষ্টি না হওয়া, মা মাছ মরে যাওয়া সেইসঙ্গে নদীর পাড় রক্ষা প্রকল্পের কাজে ড্রেজার ব্যবহার ও যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বাড়ায় ক্ষতিতে পড়ে ‘কুম’। যে কারনে ডিমের পরিমান কমে যায় আশঙ্কাজনক মাত্রায়। তবে এবারে প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় বিশেষ গেল দুই মাসে করোনায় নদী এক প্রকার নিরাপদ থাকায় ডিম ও রেনুর পরিমান আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশী মিলবে বলে জানাচ্ছেন জেলেরা।
হিসাব বলছে, গত বছর প্রায় ৭ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল হালদা থেকে। ২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি। এর আগে ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বয়ে চলছে হালদা। দুই উপজেলায় নদীর সত্তার ঘাট, অংকুরী ঘোনা, মদুনাঘাট, গড়দুয়ারা, কান্তার আলী চৌধুরী ঘাট, নাপিতের ঘোনা ও মার্দাশা এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে মা মাছ ডিম ছেড়ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ডিম সংগ্রহ করতে আর দেখতে হালদা পাড়ে ঢল নেমেছে মানুষের। তদারকিতে রয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও।
এদিকে বংশ পরম্পরায় চলে আসা প্রচলিত পদ্ধতিতে ডিম থেকে রেণু উৎপাদনতো হচ্ছেই। আধুনিক পদ্ধতিতেও চলছে এসব কমযজ্ঞ। তবে যে হারে ডিম পাওয়া যায় সে হারে রেণু হয় না। অনেক ডিমই তাপমাত্রা, আবহাওয়া, লবণাক্ততাসহ বৈরী পরিবেশে নষ্ট হয়ে যায়।
হাটহাজরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, ‘সব নৌকা এবং ডিম সংগ্রহকারীরা এখন নদীতে। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে ডিম সংগ্রহ করে তারা তীরে আসতে শুরু করেছেন। তখন জানা যাবে কত নৌকায় কত পরিমান ডিম সংগ্রহ হয়েছে।
প্রায় ৩শ নৌকায় দেড় হাজার জেলে ডিম সংগ্রহ করছেন জানিয়ে ইউএনও বলেন, এবার ১২ থেকে ১৪ হাজার কেজির মতো ডিম পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ এবার নদীর দূষণ বাড়ায় এমন দু’টি প্রতিষ্ঠান (বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পেপারমিল) বন্ধ রয়েছে। এছাড়া করোনায় লকডাউনের কারণে নদী সংলগ্ন বিভিন্ন কারখানার দূষণও নেই। ড্রেজার চলাচলও বন্ধ। এসব কারণে মা মাছের মৃত্যু তুলনামূলক কম হয়েছে। তাই এবারে ডিমও বেশী হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবছরের চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের মধ্যে পূর্ণিমা-অমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে হালদা নদীতে। আর তখনই তাপমাত্রা অনুকূলে থাকলে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ। মধ্য এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ। তবে এবার অমাবস্যা তিথি থাকলেও বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢল ছাড়াই মা মাছ ডিম ছেড়ে দিয়েছে। প্রথমে বৃহস্পতিবার ২১শে মে গভীর রাতে নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ। সকালে পূর্ণমাত্রায় ছাড়তে থাকে।
এখন যে ডিম তারা সংগ্রহ করছেন তা থেকে রেণু ফোটানো হবে। পরিচর্যার মধ্য দিয়ে সেই ডিম থেকে পোনা হবে। ডিম ফোটানোর জন্য তিনটি হ্যাচারি ও ৬০টি কুয়া প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরও কুয়া প্রস্তুত আছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘সাধারণত পূর্ণিমা বা অমাবস্যার তিথিতে ভারি বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢল নামলেই মা মাছ ডিম ছাড়ে। তবে ব্যতিক্রমও হয়। সাধারণত নদীর পরিবেশ ডিম ছাড়ার উপযুক্ত হলেই মা মাছ ডিম ছেড়ে দেয়। আর পরিবেশ উপযুক্ত কি না, সেটা দেখতে প্রথমে অল্প পরিমাণে ছাড়ে। সেটাকে স্থানীয়রা নমুনা ডিম বলে থাকেন।’