|| সারাবেলা প্রতিনিধি, হবিগঞ্জ ||
প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ের নান্দনিক ভবন। চিকিৎসা সরঞ্জামও আছে মোটামুটি। তারপরও ২৫০ শয্যার হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের নতুন এই ভবন বাস্তবে রোগীদের সেবায় তেমন একটা কাজে আসছে না। উদ্বোধনের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও জনবলসংকট, সুষ্ঠু তদারকির অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে নতুন এই বিশাল আটতলা ভবনটির বেশীর ভাগ অংশই এখনো অব্যবহৃত। অথচ এই করোনা মহামারীতেও নতুন ভবনের পেছনের পুরনো ভবনে রোগীদের গাদাগাদি পরিস্থিতিতে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। এমনকি মেঝেতেও থাকতে হচ্ছে রোগীদের। এমন পরিস্থিতিতে প্রায় ২২ লাখ মানুষের এই জেলার মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য দৌঁড়তে হচ্ছে ঢাকা কিংবা সিলেটে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ও চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতেই হাসপাতালের পুরনো ভবনের সামনে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন একটি আটতলা ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজ শেষে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নতুন ভবনটির উদ্বোধন করেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ২৫০ শয্যার হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের বিষয়টি দীর্ঘদিন ফাইল চালাচালির মধ্যে আটকে ছিল। সবশেষে জনবল নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন দেওয়া হয় চলতি বছরের ৯ই জুন। নতুন জনবল কাঠামোয় হাসপাতালে আরেও ২০ জন চিকিৎসক এবং অন্যান্য পদে ৩৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সৃজন করা হয়।
যেগুলো কোনটাই এখনো পূরণ করা যায়নি। এরআগে গত মে মাসের তালিকা অনুযায়ী হাসপাতালের অনুমোদিত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য পদের বিপরীতে কর্মরত ও শূন্য পদ হিসাব করলে দেখা যায় ৪০ জন চিকিৎসকের পদের বিপরীতে ২৪ জন এবং নার্সের ১৪১ পদের বিপরীতে ৮৭ জন কর্মরত ছিলেন। নাক, কান, গলা বিভাগ ও চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, ৬ জন মেডিকেল অফিসার, ২ জন ইএমও, ২ জন মেডিকেল অফিসার (রক্ত) এবং হেলথ এডুকেশন অফিসার পদ শূন্য রয়েছে। এর বাইরে সিনিয়র স্টাফ নার্স ৩৯, স্টাফ নার্স ৬, সহকারী নার্স ৩ জন, ২ জন ফার্মাসিস্ট এবং দন্ত, ল্যাব, রেডিওলজি, ফিজিওলজি, ইপিআই, ইসিজি, অ্যানেস্থেশিয়া, ডায়ালাইসিস, বায়োমেডিকেল ও ইকো বিভাগের ২১টি টেকনোলজিস্টের পদ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগে ২৭টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া কর্মরত ৮ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ২ জন হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে সংযুক্ত আছেন। আর মেডিকেল অফিসার (আয়ুর্বেদ) প্রেষণে নরসিংদী সদর হাসপাতালে রয়েছেন। বাস্তবে এই হাসপাতালে বর্তমানে মাত্র ২১ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ভবন তৈরি করা হলেও এই হাসপাতালে বাস্তবে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। এই করোনা মহামারীতেও শয্যার অভাবে পুরনো দ্বিতল ভবনে রোগীদের গাদাগাদি করে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। যেখানে সুষ্ঠু তদারকির অভাবে বাথরুম ও টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সদর হাসপাতালের নতুন আটতলা ভবনের দুই ও তিনতলা হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই দোতলা হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ছিল। নতুন ভবনের পাঁচতলা শিশু এবং ছয় ও সাততলা করোনা ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিচতলা ব্যবহৃত হচ্ছে করোনার টিকা কেন্দ্র হিসেবে। বাকি তলাগুলো অব্যবহৃত পড়ে আছে। হাসপাতালে করোনা রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি।
আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মোমিন উদ্দিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জানান, ৩০শে জুলাই পর্যন্ত এই হাসপাতালে করোনা পজিটিভ ৫০জন এবং করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডে ২৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা থাকলেও পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মী না থাকায় তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থাও পুরোপুরি চালু নেই। দিনে যেখানে ৬০ থেকে ৭০ লিটার চাহিদা, সেখানে মাত্র সর্বোচ্চ ১০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করার জন্য সিলেটে পাঠানো হয়। সিলেট থেকে তা মানিকগঞ্জ বা চাঁদপুর পাঠানো হয়। অক্সিজেন ভরার পর তা আবার সিলেট আসে। সবশেষে সিলিন্ডার আবার হবিগঞ্জে পাঠানো হয়। তবে জোড়াতালির এ ব্যবস্থাও বেশিদিন টেকসই হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় রোগীদের কিছুদিনের মধ্যেই আর অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব নাও হতে পারে। হাসপাতালে নতুন ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন স্থাপন করা হলেও ফিল্মের অভাবে সেই যন্ত্রের ব্যবহার আপাতত বন্ধ রয়েছে।
হাসপাতালের সদ্য বদলি হওয়া তত্ত্বাবধায়ক ডা. হেলাল উদ্দিন জানান, এক্স-রে মেশিনের সঙ্গে ৫০০টি ফিল্ম দেওয়া হয়। বর্তমানে ২০০ ফিল্ম মজুদ রাখা হয়েছে বিশেষ রোগীদের জন্য। পরবর্তী বছরে দরপত্রের মাধ্যমে একবারে ফিল্ম কেনা হবে। ফলে সাধারণ রোগীদের বাইরে থেকে এক্স-রে করতে হচ্ছে। এ ছাড়া দুটি পুরনো অ্যানালগ এক্স-রে মেশিন মেরামত না করায় তা অব্যবহৃত পড়ে আছে।
এই হাসপাতালের আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি গত বছরের মার্চ মাসে অকেজো হয়ে যাওয়ায় রোগীদের সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা যাচ্ছে না। গত বছরের মে মাসে হাসপাতালের রোগী কল্যাণ কমিটির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সাংসদ মাহবুব আলী এ সংক্রান্ত একটি আধা সরকারি পত্র (ডিও) দেওয়ার পরেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন সরবরাহ করা হয়নি।
এদিকে হাসপাতালের নতুন ভবনের লিফট নিয়েও জটিলতা দেখা দেওয়ায় রোগী ও চিকিৎসকদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘লিফটটি ছয়তলা পর্যন্ত ব্যবহারের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল। পরে আরও দুইতলা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর ফলে কারিগরি দিক দিয়ে কিছু ত্রুটি থাকায় মাঝেমধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একজন লিফটম্যান নিয়োগ করার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ’
সদর হাসপাতালের অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ জানিয়ে হবিগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহুল হাসান শরীফ বলেন, ‘এই করোনাসময়ে ওষুধের পাশাপাশি রোগীর জন্য অক্সিজেন সরবরাহ খুবই জরুরি। হবিগঞ্জ আধুনিক হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যুর খবরও পাচ্ছি; যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। হাসপাতালের বাইরে আলোকসজ্জায় লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। তা যদি চিকিৎসাসামগ্রী খাতে ব্যয় হতো তাহলে হয়তো রোগীরা মৃত্যুর আগে একটু চিকিৎসা পেতেন। ’
সদর হাসপাতালে রোগীরা প্রকৃত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) হবিগঞ্জ শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন। তিনি ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘এ হাসপাতালটিতে কোনো চিকিৎসাই হচ্ছে না। চিকিৎসকরা আছেন শুধু ঢাকা বা সিলেট মেডিকেল হাসপাতালে রেফার্ড করার জন্য। অক্সিজেনসহ চিকিৎসার সরঞ্জামাদির যে সংকট রয়েছে, এতে হাসপাতাল থাকা না থাকা সমান। শুধুই চিকিৎসক থাকলে হবে না, তারা কতটুকু চিকিৎসা দিতে পারেন, তা দেখতে হবে। সাজসজ্জার চেয়ে চিকিৎসা খাতে অর্থ ব্যয় বাড়াতে হবে। ’