রাজধানীর পাশেই প্রাণপ্রকৃতির আড়িয়ল বিল

রাজধানী থেকে বাসে শ্রীনগর উপজেলার ছনবাড়ি স্ট্যান্ডে পৌঁছাতে হবে। জনপ্রতি ভাড়া ৬০ টাকা। ছনবাড়ি থেকে শ্রীনগর বাজার অথবা গাদিঘাট এলাকার ট্রলার ঘাট থেকে বিলে ঘুরার ট্রলার পাওয়া যায়। আড়িয়ল বিল সারা দিন ঘুরতে ট্রলার ভাড়া সর্বনিন্ম ৪০০০ টাকা।

|| শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ থেকে ||
উপরে নীলাঞ্জনা আকাশ, একের পর এক উড়ে চলেছে শুভ্র-কালো মেঘমালা। নিচে দিগন্তজুড়ে কাজল কালো স্বচ্ছ জলরাশি। সে জলে ফুটেছে শাপলা-সালু সহ অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ, জলে ভিতরে নানা প্রজাতির মাছের বসবাস। স্নিগ্ধ ধমকা হাওয়ায় মৃদু ঢেউয়ের সঞ্চালন হয় জলে। ঢুল খায় ভাসমান শাপলা-সালু-কচুরিপানা। আর দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত সবুজের ছড়াছড়ি।

এসবের মাঝে আবার শঙ্খচিল, কানিবক, মাছরাঙ্গা, ডাহুক, পাতিহাঁসসহ হরেক রকমের পাখির আনাগোনা লেগেই আছে। বর্ষার এসময়টায় এমনই প্রাণ আর প্রকৃতির মিলনমেলার নয়নাভিরাম চিত্র এখন মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিল জুড়ে। প্রকৃতির এই নান্দনিকতা নয়ন জড়াবে যে কারো।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

শুধু চোখজুড়ানো নয় স্থানীয় লাখো মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস আর হাজারো বৈচিত্রময় প্রাণীর বসবাস এই বিল। বিলের দেশীয় প্রজাতির মাছ আর শীতকালের মিষ্টি কুমড়ার খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার একাংশসহ ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে আড়িয়ল বিলের অবস্থান। এখানে বর্তমানে এক লাখ ৬৭ হাজার একর জমি রয়েছে। এ জমির ওপর নির্ভর করে চলে স্থানীয় অনেকের জীবন ও জীবিকা।

ভৌগোলিকভাবে পদ্মা, ধলেশ্বরী ও ইছামতির মাঝখানে বিলটির অবস্থান।

এক সময় এ বিলের নাম ছিল চুড়াইন বিল। জানা যায়, আড়িয়াল খাঁ নামে ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখানদী প্রাচীন বিক্রমপুরের ওপর দিয়ে এক সময় প্রবাহিত হতো। সে সময় প্রাচীন বিক্রমপুরের অংশ দিয়ে বর্তমানে মাদারীপুরে এখনও আড়িয়াল খাঁ নদীর অস্তিত্ব ইতিহাসের সাক্ষী দিচ্ছে। গঙ্গাও ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তিত হলে নদীর এ অংশটুকু মৃত নদীতে রূপান্তরিত হয়। পরে এটি বিলের রূপ ধারণ করে। পূর্ব নাম চুড়াইন বিল বদলে আড়িয়াল খাঁ নদীর নামানুসারে এ বিলের নাম ‘আড়িয়ল বিল’ নামকরণ করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

আড়িয়ল বিলের বর্তমান সীমানা হচ্ছে শ্রীনগর উপজেলার দক্ষিণে দয়হাটা, শ্যামসিদ্ধি, প্রাণিমণ্ডল, গাদিঘাট, রাড়িখাল ও মাইজপাড়া। উত্তরে শ্রীধরপুর, বাড়ৈখালী, শেখরনগর, মদনখালী, সুতারপাড়া, আলমপুর ও তেঘরিয়া। পূর্বে হাঁসাড়া, ষোলঘর, কেয়টখালী, লস্করপুর ও মোহনগঞ্জ। আর পশ্চিমে কামারগাঁও, বালাসুর, জয়পাড়া, জগন্নাথ পট্টি, কাঁঠালবাড়ী ও মহুতপাড়াগ্রামগুলো অবস্থিত।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

বিলে ছোট-বড় মিলে প্রায় হাজারখানেক জলাধার, ডোবা ও পুকুর থাকলেও বড় ডাঙাগুলো পূর্বে স্থানীয় জমিদার বা রাজারা খনন করেছিলেন। বিলের দক্ষিণ প্রান্তের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিঘি হচ্ছে নৈমুদ্দিন, সানাইবান্ধা, বাগমারা, সাগরদিঘি, বৈরাগীরডাঙা, খালেকসাবডাঙা, মনসা, কালাচান দিঘি, বসুমালা, কলাগাছিয়া, নারকেলগাছিয়া, তালগাছিয়া, ঝরঝরিয়া, পরশুরাম, আঠারোপাখি, সাচরাতি, সেলামতি প্রভৃতি।

ভরা মৌসুমে এ বিলে প্রচুর দেশি মাছ ধরে হাজারো পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। পরে বিলে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। এরপর থেকেই আড়িয়ল বিলে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ হতে থাকে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতকালে অপেক্ষাকৃত উপরাংশে রবিশস্য ও মাটি কেটে ভিটিতে করলা, খিরা, টমেটো, কুমড়া, লাউ প্রভৃতি শাকসবজির আবাদ শুরু করেন কৃষকরা।

আড়িয়ল বিলে এক সময় অসংখ্য দেশি ও বিদেশি পাখির আনাগোনা ছিল।বুনোহাঁসগুলো সকালে পদ্মার চরে আশ্রয়ে থাকত। পরে সন্ধ্যা হলেই দল বেঁধে আবার বিলে ফিরে আসত। বিলের চারপাশে মাছ এবং সবজির দৈনিক ও সাপ্তাহিক হাট বসত। কাছের মাইজপাড়া সংলগ্ন ‘অদেরপাড়ের হাট’ থেকে গ্রামের লোকজন বর্ষাকালীন ছয় মাসের কুমড়া কিনে এনে ঘরের চৌকির নিচে রেখে দিত।

অতীতে আড়িয়ল বিলে ২০-২৫ হাত পানি হতো। বিশাল বিশাল ঢেউ উত্তর দিকে আছড়ে পড়ত। গরুর খাবারের জন্য অনেকেই ‘মনকা’ নামে দল-জাতীয় ঘাস বড় নৌকায় করে বিল হতে তুলে নিয়ে বাড়ির পাশে পানিতে রেখে মজিয়ে গরুকে খাওয়াতেন। বিলের ঢেউয়ের কারণে উত্তরের জনপদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। উঁচু বাড়ির মাটি ঢেউয়ের আঘাতে পাড় ভেঙে পড়ত। আমন ধান ঢেউয়ের তোড়ে অথবা কচুরিপানায় নষ্ট হয়ে যেত। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ফসল ও ঘরবাড়ি রক্ষার আবেদন জানালে সরকার আলমপুর হতে পশ্চিমে প্রায় আট কিলোমিটার গজারি গাছের খুঁটি পুঁতে কয়েক স্তর মোটা তার লাগিয়ে দেয়। ফলে বেড়ার দক্ষিণ পাশে জমে থাকা কচুরির স্তূপের কারণে ঢেউ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হলে উত্তরের জনপদে স্বস্তি নেমে আসে। রাড়িখাল সংলগ্ন বিলে গেলে উত্তর দিকে তাকালে সারি সারি খুঁটির রেখা দেখা যেত।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

৮০’র দশকের মাঝামাঝি হতে খুঁটিগুলো আর দেখা যায়নি। এগুলো নানা কায়দায় বেহাত হয়ে গেছে। বিলের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ব্যর্থ ঝগই বাঁধ ও কজই বাঁধের কারণে পদ্মার জোয়ারের পানি ঢোকার সবগুলো প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে আছে।
এমনকি শ্রীনগর-ভাগ্যকূল সড়কের আগের সাতটি কাঠের ও একটি লোহার পুল তুলে ফেলে সে স্থানগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়। এ বিলে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর নির্মাণের কথা ছিল। এলাকার কিছু লোক ও পরিবেশবাদীরা আড়িয়ল বিল রক্ষায় আন্দোলনে নামেন। সরকারও সে সময় এখান থেকে সরে দাঁড়ায়। কিন্তু ভূমি দখলদারদের আগ্রাসন মোটেও থেমে নেই। দিন দিন নতুন নতুন বসতির লোকালয়, ইটভাটা, ইট তৈরির জন্য বিলের টপসয়েল কেটে নেওয়া প্রভৃতি বাধাহীনভাবেই চলছে।

পানির অভাবে ডাঙাগুলোয় এখন প্রাকৃতিক মাছ সেভাবে পাওয়া যায় না; তাই বাধ্য হয়ে জেলেরা কৃত্রিম পোনা ছাড়ছেন। এভাবে চলতে থাকলে আড়িয়ল বিল কয়েক বছরে তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে।

বিক্রমপুরের আড়িয়ল বিলঘেঁষা গাদিঘাট গ্রামের নুর মোহাম্মদ বলেন, আমাদের স্কুলজীবনে এখানের যাতায়াতব্যবস্থা ভালো ছিল না। বাঁশের সাঁকো, পানি-কাদা মাড়িয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হতো। শিক্ষকদের দেখেছি ঢোলা পায়জামা পরে ক্লাসে আসতেন। রাস্তায় পানি-কাদা থাকায় পায়জামা ঢোলা হলে হাঁটুর ওপড় টেনে ওঠাতে সহজ হয়। ৭৯ সালে আমাদের বাড়ির পাশে শ্রীনগর-ভাগ্যকূল রোডে পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি লাগানো হয়।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

তবে এখন বর্ষায় পানিতে টইটুম্বুর থাকলেও শীতকালে এটি বিস্তীর্ণ শস্য ক্ষেতে পরিণত হয়। এখানে শীতকালে নানা ধরনের সবজির চাষ করা হয়।

যেভাবে যাবেন আড়িয়ল বিল-
ঢাকার গুলিস্তান থেকে শিমুলিয়া ঘাটগামী নিয়মিত বিরতিতে ইলিশ, স্বাধীন বসুমতি, প্রচেষ্টা, আপন বাস ছাড়ে। রাজধানী থেকে বাসে শ্রীনগর উপজেলার ছনবাড়ি স্ট্যান্ডে পৌঁছাতে হবে। জনপ্রতি ভাড়া ৬০ টাকা। ছনবাড়ি থেকে শ্রীনগর বাজার অথবা গাদিঘাট এলাকার ট্রলার ঘাট থেকে বিলে ঘুরার ট্রলার পাওয়া যায়। আড়িয়ল বিল সারা দিন ঘুরতে ট্রলার ভাড়া সর্বনিন্ম ৪০০০ টাকা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন