মানুষ ঘরে থাকলেই আমরা আরো ভাল থাকবো

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

বিশ্বজুড়ে করোনাবিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে ‘আমরা তুলনামূলকভাবে ভালো আছি’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই ভাল থাকাটা আরো ভাল হবে যখন আমরা সবাই করোনা প্রতিরোধে আচরিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবো। সবাইকে ঘরে থাকবার অনুরোধ জানানোর পরও অনেকেই তা মানায় উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ যদি এভাবে বাইরে বের হয়, তাহলে কোভিড-১৯ রোগটি ছড়িয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বাংলাদেশেও গত ২৬শে মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে বলা হয় ঘরে থাকতে। কেননা করোনা নিরাময়ের এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক বা ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় জনে জনে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাই একমাত্র পন্থা হিসেবে এখন পুরো বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানাতে সারাদেশেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

শনিবার জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনে সমাপনী বক্তব্যে চলমান সঙ্কটের নানা দিক তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের দেশের মানুষ সাহসী হতে গিয়ে একটু বেশি সাহসী হয়ে গেছে! তাদেরকে বারবার ঘরে থাকা অনুরোধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিনরাত যথেষ্ট কষ্ট করছে। কিন্তু কেন যেন মানুষ এটা মানতে চায় না। দেখা যায় এখানে বসে আড্ডা ওখানে বসে গল্প। বলা হল ঘরে থাকেন, বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গেল। শিবচর থেকে টুঙ্গিপাড়া হাজির। ভাইরাস টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত পৌঁছে গেল। নারায়ণগঞ্জ থেকে চলে গেল বরগুনা।”

মানুষের এই ধরনের কর্মকাণ্ড অন্যদের ঝুঁকিতে ফেলার পাশাপাশি রোগ বিস্তার রোধের কাজটি যে কঠিন করে তুলছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “আমরা বারবার অনুরোধ করছি, আপনারা যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকেন। আমরা এটাকে একটা জায়গায় ধরে রাখতে পারি এবং সেখান থেকে মানুষকে যদি সুস্থ করতে পারি, তাহলে কিন্তু এটা বিস্তার লাভ করে না। সংসদে যারা এসেছে, সবাই মাস্ক পরে এসেছেন, কিন্তু বাইরে যারা আছেন এ ব্যাপারটা দেখতে হবে। কেন যেন মানুষ সেটা মানতেই চায় না।”

সরকারের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের চেষ্টা হচ্ছে মানুষের জীবনটাও যেন চলে, তারা যেন সুরক্ষিত থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই নির্দেশনা মেনে চললে নিজে যেমন সুরক্ষিত থাকতে পারবেন, অপরকেও সুরক্ষিত রাখতে পারবেন। কারও জীবন ঝুঁকিতে পড়বে না। নিয়ম না মানার কারণে সে নিজেও ঝুঁকিতে পড়বে, অন্য কয়েকজনকে অসুস্থ করে ফেলবেন। এজন্য আমি সবাইকে অনুরোধ করব নিজে সুরক্ষিত থাকুন। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা মেনে চলুন।”

সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঝড়-ঝাপটা দুর্যোগ তো আসে, আসবেই। এ সময় হতাশ হওয়া বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সাহসের সাথে এটা মোকাবেলা করতে হবে। যে যেখানে আছি, যার যার অবস্থানে থেকে এটা মোকাবেলা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে এত বড় দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা দেশের আগে কখনও হয়নি বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তারপরও বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় আছে।

“আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেছি। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগে এরকম একটা ঝড় উঠবে, তা আমাদের কল্পনাতীত ছিল। ভাইরাসসহ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ এবং আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা থেকে পদক্ষেপ নিই।

“প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা এখন পারদর্শী, কিন্তু করোনাভাইরাস এটা একটা অদ্ভুত বিষয়, সত্যি কথা বলতে কি এর অভিজ্ঞতা সারাবিশ্বে কারণ নেই। তারপরও তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ অন্য দেশের চেয়ে যথেষ্ট ভালো আছে। বিশ্ব যেখানে দৈনিক হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, সেখানে আমরা অনেকটা ভালো আছি।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সশস্ত্র বাহিনী স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যেকেই আন্তরিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

মহামারী নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর হিমশিম খাওয়ার দিকটি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “কতই না শক্তিশালী দেশ, কত তাদের শক্তিশালী অস্ত্র, কোনো কিছুই কাজে লাগল না!

একটা ভাইরাস যেটা চোখে দেখা যায় না, তার কারণে সারা বিশ্বে স্থবির। সারা বিশ্বের মানুষ ঘরে বন্দি। ধরণীর অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বোধহয় আর কখনও কেউ পড়েনি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কতদিন এই মহামারী চলবে, তা এখনও জানাতে পারছে না বিজ্ঞানীরাও।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটা নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে, চিন্তা হচ্ছে। অনেকে বলছেন শীতকালে বেশি হবে, গরমকালে বেশি থাকবে না- এখন বলা হচ্ছে গরমেও থাকবে। একটা অদ্ভুত অবস্থা সারাবিশ্বে।”

‘কিটের অভাব নেই’

সরকার এ পর্যন্ত ৯২ হাজার কিট সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ২০ বিতরণ করা হয়েছে, ৭২ হাজার মজুদ রাখা হয়েছ।

কিট সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য আলাদা আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। মোট আইসোলেশন ওয়ার্ড সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ২০০। এছাড়া ভবিষ্যতের জন্য জেলা হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে পাশাপাশি কিছু বেসরকারি হাসপাতালকে অনুরোধ করা হয়েছে, যদি রোগীর সংখ্যা বাড়ে তাহলে চিকিৎসার সেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা করা যায়।

এই সঙ্কটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জাতিসংঘ ইউএন-এইড, ইউকে-এইডসহ অনেক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বাংলাদেশের পাশে রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান।

তিন ধাপে প্রণোদনা প্যাকেজ

করোনা বিপর্যয়ের আর্থিক অভিঘাত মোকাবেলায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সঙ্কটটা যাতে কাটিয়ে উঠতে পারি, তার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। অর্থনৈতিকভাবে যে নেতিবাচক দিনগুলো সামনে আসতে পারে সেগুলো বিবেচনা করে আমরা কর্মসূচি নিয়েছি। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের কথা বিবেচনা করে প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ আমরা দিয়েছি। অর্থনীতি যাতে গতিশীল থাকে যার জন্য আমরা তিন ভাগে এই সুযোগটা দিচ্ছি।”

তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারগুলি যাতে খাদ্যে কষ্ট না পায় সেজন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। দুর্ভিক্ষ যদি বিশ্বব্যাপী হয় আমাদের দেশে মানুষ যাতে দুর্ভিক্ষে না পড়ে তার জন্য আগাম তিন বছরের বিষয়টি মাথায় রেখেই প্যাকেজ ঘোষণা করেছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের খাদ্যের অভাব নেই, অভাব হবেও না। কৃষি উৎপাদন যদি অব্যাহত থাকে তার জন্য আমরা নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। ৪ পারসেন্ট হারে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।”

শিক্ষার্থীদের ধান কাটার আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সারাদেশেই বোরো মৌসুমের ধান কাটা শুরু হয়েছে। দিনমজুর যারা এখন কাজ পাচ্ছেন না তাদের জন্য এটা একটা সুযোগ। তারা এখন ধান কাটতে যেতে পারেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া আছে, যারা যেখানে ধান কাটতে যেতে চায়, তাদের সেখানে পৌঁছে দেওয়া হবে।”

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “কেবল দিনমজুর নয় সকলেরই যাওয়া উচিত এখানে, কেবল উঁচু-নিচু নয়, কাজ করা সকলের দায়িত্ব। ছাত্র-শিক্ষক সকলকে বিশেষ করে ছাত্রদেরকে আমি বলবো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেন একটু এগিয়ে আসে। সকলে মিলে ধানটা যদি আমরা ভালোভাবে চলতে পারি। আমাদের খাবারের কোনো অভাব হবে না।”

চিকিৎসা সেবার হটলাইনে ফোন দিয়ে অনেকে খাবারও চাচ্ছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা হাত পাততে পারেন না, কিন্তু বাড়িতে খাবার নেই, এই তথ্যটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আমি দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছি এই হটলাইনের সাথে সমন্বয় করার জন্য যদি কেউ সাহায্য চায় সঙ্গে সঙ্গে যেন তা পৌঁছে দেওয়া হয়।”

সরকারি পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, “১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণের জন্য ৫০ লাখ কার্ড আমাদের দেওয়া আছে। আরও ৫০ লাখ কার্ড করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটা শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি কার্ড করা হচ্ছে। এতে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ সুবিধা পাবে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্ব থেকে ইতিমধ্যে খাদ্য দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের উর্বর মাটি আছে, মানুষ আছে, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা যে যা পারি তরিতরকারি হোক ছাদে হোক মাটিতে হোক উৎপাদন করতে পারি। আমরা নিজেরা চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশকে দিতে পারি।”

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেও নিয়ম রক্ষার জন্য এবার সংসদের এই অধিবেশন বসেছিল মাত্র দেড় ঘণ্টার জন্য, যা দেশের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম অধিবেশন।#

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন