বারো ঘন্টা আগে জেনেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ
|| ডয়েচে ভেলে, ঢাকা ||
সুনামগঞ্জে হিন্দু পল্লীতে হামলা হয় মাইকে ঘোষণা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে৷ পুলিশ অন্ততঃ ১২ ঘন্টা আগে তথ্য জানার পরও হামলা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ৷ হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের সমালোচনা করে পোস্ট দেয়ার জেরে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দুপল্লীতে এই হামলা চালানো হয়৷ হামলাকারীরা দুইটি দলে ভাগ হয়ে বন্ধ ঘরে ঢুকে ভাঙচুর করে, আলামারি ভেঙে ফেলে, স্বর্ণালঙ্কার, মূল্যবান সামগ্রী ও টাকা পয়সা লুট করে৷ মোট ৮৮টি ঘরে হামলা চালিয়ে তারা লুটপাট করে৷ আর যে নারী ও শিশুরা পালাতে পারেনি তাদের মারধোর করে৷ বিশেষ করে জুমন দাসের স্ত্রী ও স্থানীয় ইউপি চেয়াম্যানের স্ত্রীকে ব্যাপক মারপিট করে৷ ইউপি চেয়ারম্যানের স্ত্রী বাথরুমে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তাকে সেখান থেকে টেনে বের করে মারপিট করা হয়৷ ৭-৮টা পারিবারিক মন্দির ছিলো সেগুলোও ভাঙচুর করা হয়৷ মন্দিরের প্রতিমাও তারা ভেঙে ফেলে৷
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/034308Sunamgonj_kalerkantho_pic.jpg?resize=1053%2C636&ssl=1)
বুধবার সকালে হামলার দুইদিন আগে সোমবার হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হক শাল্লার পাশের উপজেলায় দিরাইতে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন৷ শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামের জুমন দাস নামে এক হিন্দু যুবক তখন মামুনুল হকের সমালোচনা করে একটি ফেসবুক পোস্ট দেন৷ তার জেরে মঙ্গলবার রাত ৮ টার দিকে পাশের কাশিপুরসহ আরো কয়েকটি গ্রামের হেফাজত সমর্থকেরা প্রথমে হিন্দুপল্লী নোয়াগাঁও আক্রমণ করতে আসে৷ কিন্তু ওই যুবককে তখন স্থানীয় হিন্দু নেতারা ধরে পুলিশে দেন এবং উত্তেজিত হেফাজত সমর্থকদের নিবৃত করতে সমর্থ হন৷ তারা হামলা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান৷ কিন্তু বুধবার সকালে মাইকে ঘোষণা দিয়ে কয়েক হাজার লোক হামলা চালায়৷
শাল্লার হবিপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রাম ও পাশের কাশিপুর নারায়ণবাজার, হবিপুরের মধ্যে ছোট একটি নদী দারাই৷ ওই নদীর ওপর সাঁকো পার হয়েই নয়াগাঁও গ্রামে আসতে হয়৷
স্থানীয় ইউপি সদস্য বিশ্বরূপ দাস জানান, হাজার-দেড় হাজার লোক যখন সকালে লাঠি, রামদা নিয়ে আক্রমণের জন্য আসে তা নদীর এপার থেকেই দেখা যায়৷ তাদের দেখে গ্রামের লোকজন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান৷ কিন্তু নারী ও শিশুদের একটি অংশ পালাতে পারেননি৷ হামলাকারীদের একটি অংশ সাঁকোর ওপারে অবস্থান করে আর আরেকটি অংশ গ্রামে ঢুকে বাড়ি ঘরে হামলা চালায়৷ তিনি জানান, ‘‘মঙ্গলবার রাতে তারা প্রথম যখন হামলা চালাতে আসে তখন তারা হয়ত রাত দেখে চলে যায়৷ আর আমরাও জুমন দাসকে ততক্ষণে পুলিশের হাতে দিয়েছি, যাতে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়৷ কিন্তু তারা হামলা না চলানোর প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও পরদিন সকালে হামলা চালায়৷” তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘পুলিশ পুরো ঘটনা জানত৷ তারা যে হামলা করতে এসে ফিরে গেছে তাও জানত৷ আর জুমন তো তাদের হেফাজতেই ছিল৷ তারপরও আমাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ পুলিশ মোতায়েন করা হলে তারা হামলা চলাতে পারত না৷”
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, বুধবার সকালে হামলা শুরুর পর মাত্র ১০-১৫ জন পুলিশ আসে৷ তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হামলা দেখেছেন৷ তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেনি৷ ওই কয়জন পুলিশের পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিল না৷ হামলাকারীরা এক-দেড়ঘন্টা পর চলে গেলে পুলিশ আসে৷
তিনি অভিযোগ করেন, পাশের এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাদেরও অনুরোধ করা হয়েছিল যেন তারা হামলা থামানোর ব্যবস্থা নেন৷ আর হামলায় নেতৃত্ব দেয় চণ্ডীপুরের স্বাধীন মেম্বার, পাক্কন মিয়াসহ আরো অনেকে৷ তবে স্বাধীন মেম্বার অভিযোগ অস্বীকার করেন৷
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/download-1-6.jpg?resize=1056%2C668&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/download-1-6.jpg?resize=1056%2C668&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/download-1-6.jpg?resize=1056%2C668&ssl=1)
সুনামগঞ্জ পুজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিমল বণিক বৃহস্পতিবার সরেজমিন নোয়াগাঁও গ্রাম পরির্দশন করেছেন৷ তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘হামলা ঠেকাতে পুলিশ আগাম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ আগের রাত থেকে উত্তেজনা চলছিল৷ পুলিশকে জানানোর পরও পুলিশ ছিলো নির্বিকার৷ মাঠে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বুধবার সকালে হামলা চালানো হয়৷”
তিনি জানান, ‘‘একজন শ্রমিকদের টাকা দেয়ার জন্য ঋণ করে এক লাখ টাকা এনেছিলেন তাও নিয়ে গেছে হামলাকারীরা৷ যারা পালাতে পেরেছেন তারা সঙ্গে করে কেউ কেউ গরু বাছুরও নিয়ে যান৷”
শাল্লা থানা ওসি নাজমুল হক বৃহস্পতিবার বিকেলে জানান, হামলার ঘটনায় সন্দেহজনকভাবে তারা একজনকে আটক করেছেন৷ মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে৷ এদিকে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার ঘটনায় আগের রাতেই হিন্দু যুবককে আটক করার কথা স্বীকার করেন তিনি৷ ওই গ্রামের লোকজনের থানায় যাওয়ার কথাও জানান তিনি৷ তারপরও কেন আগাম নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হলোনা জানতে চাইলে বলেন, ‘‘হামলা হবে সেটা আমরা ধারণা করতে পারিনি৷” হামলার দিন সকালেও কেন প্রথমে অল্প সংখ্যক পুলিশ পাঠানো হল তারও কোনো জবাব দিতে পারেননি ওসি৷ তিনি শুধু বলেন, ‘‘যাই হোক এখন পুলিশ আছে৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে৷” কারা এই হামলায় জড়িত তাও তদন্তের আগে বলা যাবে না বলে জানান তিনি৷
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘‘আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় স্থানীয় হেফাজতে ইসলামের লোকজন এই হামলা চালিয়েছে৷ তদন্তে আরো বেরিয়ে আসবে৷”
গ্রামবাসীরা পুলিশকে জানানোর পরও আগে কেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয় হয়নি জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘‘এটা পুলিশের বিষয়৷ কারুর কোনো গাফিলতি থাকলে তা বেরিয়ে আসবে৷ বুধবার ঘটনার পর আমি ও এসপি ওই এলাকায় গিয়েছি৷ বৃহস্পতিবার র্যাবের মহাপরিচালক এসেছিলেন৷” র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বাড়ি এই শাল্লা উপজেলায়৷ তার ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান৷
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/download-2-3.jpg?resize=1057%2C597&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/download-2-3.jpg?resize=1057%2C597&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/download-2-3.jpg?resize=1057%2C597&ssl=1)
হামলার শিকার যারা হয়েছেন তাদের জন্য জেলা প্রশাসন সাত মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে৷ আর কিছু পরিবারকে ক্ষতিপুরণ দেয়া হবে বলে তিনি জানান৷
এদিকে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মুখপাত্র মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী হামলার দায় অস্বীকার করে বলেন, ‘‘স্থানীয় লোকজন যারা হামলা করেছে তাদের সাথে হেফাজতের কী সম্পর্ক? তাদের গায়ে কি হেফাজত লেখা আছে৷ এটা হেফাজতকে হেয় করার একটা ষড়যন্ত্র৷”
তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের হামলাকে হেফাজতে ইসলাম সমর্থন করে না৷ পুলিশের কাজ হলো যারা হামলা করেছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করা৷” নোয়াগাঁও গ্রামটিতে প্রায় দেড় হাজার লোকের বসবাস৷ তারা প্রায় চারশ’ পরিবার৷ পুরো গ্রামটিই হিন্দু অধ্যুষিত৷ এখন অনেকেই গ্রামে ফিরে আসলেও তাদের সব কিছু শেষ হয়ে গেছে৷ হাওর এলাকার এই গ্রামের মানুষ মূলত মৎসজীবী৷ আর এক ফসলি জমির ওপর নির্ভর করে তাদের জীবন চলে৷