বেহাল দশায় নাঙ্গলকোটের গোহারুয়া হাসপাতাল

হাসপাতালটির মুল ভবন এবং আবাসিক ভবনের দরজা নেই, জানালার গ্লাসও ভেঙ্গে গেছে।  বাথরুমগুলোর বেসিন ও কমেড ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

|| মো. বশির আহমেদ, নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) ||

গেলো পনেরো বছরেও চালু করা যাচ্ছে না নাঙ্গলকোটের গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল।  দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যাক্ত থাকায় হাসপাতালটির মুল ভবন এবং আবাসিক ভবনের দরজা নেই, জানালার গ্লাসও ভেঙ্গে গেছে।  বাথরুমগুলোর বেসিন ও কমেড ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন রুমগুলোতে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। এছাড়া, হাসপাতালের লাইট, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, আলমিরা, চেয়ার, টেবিলসহ সব চুরি হয়ে যায়।

মাদকসেবীদের আড্ডা চলে আবাসিক ভবনগুলোতে। হাসপাতালের ভেতরে ঝোঁপ-জঙ্গল, সবজির বাগান, ছাগলের খোয়াড় গড়ে তুলেছেন হাসপাতালসংশ্লিষ্টরা।হাসপাতালের সামনের জমিতে মাছচাষ করছেন প্রভাবশালীরা। সীমানা প্রাচীর না থাকায় হাসপাতালটি অরক্ষিত এবং উত্তর পাশের মাটি ভেঙ্গে যাওয়ায় হুমকিতে পড়েছে হাসপাতালের মূলভবন।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে জোড্ডা ইউনিযনের গোহারুয়া গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান আমিন ভূঁইয়া ও তার ভাইয়েরা হাসপাতালের জন্য তিন একর জমি দান করেন।  ২০১৪ সালের ১৫ই এপ্রিল তৎকালীন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়া প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গোহারুয়া ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটির ভিত্তি স্থাপন করেন। লক্ষ্য ছিলো নাঙ্গলকোটের প্রত্যন্ত এলাকা জোড্ডা ইউনিয়নের গোহারুয়া, নিশ্চিন্তপুর, মান্দ্রা, মানিকমুড়া, দামুরপাড়, পাশ্ববর্তী মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া, বিনয়ঘর, ভোগই ও নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার বিরাহিমপুর গ্রামের অর্ধ লক্ষাধিক তৃণমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।

পরে জোট সরকারের শেষ দিকে ২০০৬ সালের ১৭ই অক্টোবর তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী আমান উল্ল্যা হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। আবাসিক ভবন নির্মাণসহ আন্তবিভাগ ও বহির্বিভাগের সুবিধা নিয়ে হাসপাতালটি চালু করা হয়। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৪ সালের শেষ দিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দাবির মুখে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সার্বিক সহযোগিতায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের  উপস্থিতিতিতে ওই সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি হাসপাতালটিতে শুধু বহির্বিভাগে স্বাস্থ্যসেবা চালু করেন।

কিন্তু সীমানা প্রাচীর ও মূল ভবনসহ আবাসিক ভবন সংস্কার না করে বহির্বিভাগ চালু করলেও কোন ওষুধ বরাদ্দ না থাকা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন না থাকায় আন্তবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে আবারো স্থবির হয়ে পড়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

হাসপাতালটিতে যাতায়াত ব্যবস্থা অনুন্নত, সীমানা প্রাচীর না থাকা, বিলের মধ্যে হাসপাতালটি স্থাপন, ডাক্তার, নার্স, কর্মচারী, ল্যাব, পরিচ্ছনাকর্মী না থাকায় হাসপাতালটিতে রোগী আসতে চান না। প্রতিদিন বহির্বিভাগে  ৪/৫ জন রোগী আসেন। এই অবস্থায় ২০১৯ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকে জুনিয়র কনসালেন্ট (গাইনী) মাতুয়ারা শারমীন দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া, মেডেকেল অফিসার আয়েশা আক্তার শেফাকে এখানে পদায়ন করা হলেও তার পরিবর্তে তার স্বামী ডা, মাহবুব হাসান নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। সিনিয়র ব্রাদার আজিজুর রহমান ও টিকেট কাউন্টার লিপি আক্তারকে এখানে পদায়ন হলেও তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করেন। একমাত্র ওয়ার্ড বয়  রাকিবুল হাসান হাসপাতালটি দেখভাল করছেন।

হাসপাতালের উত্তর পাশে  সীমানা প্রাচীর না থাকায়  প্রায় ৭ ফুট অংশ মাছ চাষের একটি দিঘীতে (বড় পুকুর)  বিলীন হয়ে গেছে। ধীরে-ধীরে দিঘীটি হাসপাতালের দিকে ভেঙ্গে যাওয়ায় যে কোন মুহুর্তে হাসপাতালের ভবন দিঘীতে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হাসপাতালাতে ঢুকতে দু‘পাশের নিচু জমিতে গোহারুয়া গ্রামের জিয়াউল হক খান ও নুরুল হক দখলে নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে মাছ চাষ করছেন। জানা যায়, তারা প্রতিবছর ৩০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাছ চাষির নিকট জমিগুলো বন্ধক দিয়েছেন।তারা এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চান না।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

হাসপাতালে সেবা নিতে আসা গোহারুয়া গ্রামের শেপালী বেগম জানান, ওয়ার্ডবয় রাকিবুল হাসানের কাছে ডাক্তার আসার খবর পেয়ে তার প্রসূতি পুত্রবধু তানজিলাকে গাইনী বিশেষজ্ঞ মাতুয়ারা শারমীনকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। একই গ্রামের ইয়াছিন (৪৫) জানান, তার মেয়ে সুরাইয়ার (২০মাস) সর্দি, কাশি হওয়ায় মেডিকেল অফিসার ডাঃ মাহবুব হাসানকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। এছাড়া একই গ্রামের উম্মে হানি (৩২) তার ছেলে আহম্মদ উল্ল্যাকে ( ২) জ¦র ও কাশি নিয়ে ডাঃ মাহবুব হাসানকে দেখাতে আসেন। কিন্তু ডাক্তার না আসায় দু‘জন তাদের মেয়ে এবং ছেলেকে  ডাক্তার না দেখিয়ে ফিরে যান।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ দেব দাস দেব এর কাছে এসম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, বর্তমানে হাসপাতালটিতে বহিঃবিভাগ চালু থাকলেও কোন ওষুধ বরাদ্দ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকায় আন্তঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালটির প্রধান সমস্যা হচ্ছে সীমানা প্রাচীর নেই। হাসপাতালটি একটি বিলের মধ্যে এবং দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত। ওই এলাকাটি আন্তঃজেলা ডাকাত দলের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। নিরাপত্তা প্রহরী না থাকায় হাসপাতাল এলাকাটিতে নিরাপত্তার সংকট রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মচারীরা এখানে থাকতে চান না। হাসপাতালটির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং আবাসিক ভবন সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

তিনি আরো বলেন, হাসপাতালটির সীমানা প্রচীর নির্মাণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে। হাসপাতালটিতে ঢুকতে দু‘পাশের জমি অবৈধ দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, জমিগুলো আমাদের কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। হাসাপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য সেবা চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে

সংবাদ সারাদিন