|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
চাল ডাল তেল পেঁয়াজ সবজি- কোথাও স্বস্তি নেই। সবকিছুর বাজারেই যেন আগুন। নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যে দিশেহারা সবাই। নিম্নআয়ের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এ সময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ‘রুটিন’ অভিযান থাকলেও বাজারে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, বাজারের নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে? সরকার প্রতি কেজি আটাশ চালের দাম নির্ধারণ করেছে ৪৬ টাকা। তবে বাজারে সেটি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। আর সবচেয়ে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৪৯ টাকায়। যদিও তার নির্ধারিত মূল্য ৩৭ টাকা। আলুর নির্ধারিত দাম ৩৫ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৫ টাকা। ১ মাসে ডালের দাম বেড়েছে ১৫-২০ টাকা। আর সবজির বাজার কয়েক মাস ধরেই তুঙ্গে। ৮ ও ৯ই নভেম্বর দুই দিন রাজধানীর বাজারগুলোর চিত্র ছিল এরকম।
গত ২৮শে অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে ৩৭ টাকা কেজি দরে চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে সেই মোটা চাল নির্ধারিত দামের চেয়েও ১০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। এর আগে ২৯শে সেপ্টেম্বর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্য ভবনের সম্মেলন কক্ষে চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। চালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পেক্ষাপটে ওই বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠকে মন্ত্রী মিনিকেট চালের মূল্য ৫২ টাকা এবং আটাশ চালের মূল্য ৪৬ টাকা বেঁধে দেন। এই দাম না মানলে চাল আমদানি করা হবে বলে তিনি ঘোষণা দেন। মন্ত্রীর নির্দেশনা চাল ব্যবসায়ীরা মানেননি। ঘোষণার পর এক মাসের বেশি পেরিয়ে গেলেও চাল আমদানির কোনো খবরও পাওয়া যায়নি।
৯ই নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, শুক্রাবাদ, কারওয়ান বাজার ও পশ্চিম রাজাবাজারে দেখা যায়, একেক বাজারে পেঁয়াজ একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের খুচরা দোকানে দেশি পেঁয়াজ ৮৫ টাকা, আমদানি করা ছোট পেঁয়াজ ৭০ টাকা, আমদানি করা বড় পেঁয়াজ ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গুলিস্তান, শুক্রবাদ ও পশ্চিম রাজাবাজারে দেশি পেঁয়াজ ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও আমদানি করা পেঁয়াজ জাত ও মানভেদে ৪৫-৭০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ৬০ টাকায় দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে দামের বিষয়ে জানতে চাইলে সায়েম স্টোরের দোকানি বলেন, ‘আমাদের কেনা বেশি পড়েছে।’ তবে পেঁয়াজের দাম নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। সেলফ সাফিশিয়েন্ট হতে হবে। এ জন্য দুই বছর সময় লাগবে। দুই বছরের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ২৮শে অক্টোবর সংসদ ভবনে ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’র বৈঠকে মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়।
সরকার প্রতি কেজি আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও তা ৪৫ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না। সেপ্টেম্বরেও ২০-২২ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া আলু বর্তমানে কোনো কোনো বাজারে ৫০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হতে দেখা গেছে। মূল্যবৃদ্ধির পরে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩০ টাকা বেঁধে দেয় সরকার। তবে এই মূল্য কার্যকর করা যায়নি। এর দুই সপ্তাহ পর ২০ অক্টোবর আলুর দাম সব পর্যায়ে গড়ে ৫ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু সেটিও কার্যকর করা যায়নি। ২১শে অক্টোবর সচিবালয়ে অ্যাগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরাম- এআরএফ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আলুর দাম ৩৫ টাকা, এটাও অনেক দাম। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করে আমরা ৩৫ টাকা করে দিলাম। কিন্তু আলুর দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ ব্যবসায়ী, আড়তদারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা মুনাফা করেন, মুনাফা করার জন্যই ব্যবসা করছেন। কিন্তু এ সুযোগে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার চিন্তা করবেন না। মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারা সরকারের নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করুন।’ তবে কৃষমন্ত্রীর সেই অনুরোধ, নির্দেশ কিছুই মানেননি ব্যবসায়ীরা।
বাজারে সবকিছুই যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন সেই তালিকায় যোগ দিয়েছে তেল এবং ডালও। সরেজমিনে দেখা যায়, চিকন মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা কেজি, মোটা মসুর ডাল ৭৫-৮০ টাকা কেজি। যাত্রাবাড়ীর বিসমিল্লাহ স্টোরের দোকানি বলেন, এক মাসে দুই ধরনের ডালের দাম কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে গত সপ্তাহে খোলা সয়াবিন বাজারে বিক্রি ৯৭-৯৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও ৯ই নভেম্বর তা বিক্রি হচ্ছে ১০৪-১০৫ টাকা।
প্রতিবছর সাধারণত বর্ষা ও বন্যার মৌসুমে সবজির দাম বাড়লেও শীত আসতেই সব ধরনের সবজির দাম কমতে থাকে। কিন্তু এবার মধ্য নভেম্বরের এক সপ্তাহ চলে গেলেও সে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। সবচেয়ে সস্তার সবজি আলুই ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য সবজির দাম আরো বেশি। বেগুন, করল্লা, চিচিঙ্গা, পটোল, ঢেঁড়স, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, শসাসহ প্রায় সব সবজিই বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজিতে। তবে শিম এবং টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০০-১২০ টাকায়।
বাজারমূল্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন নামের কারওয়ান বাজারের একজন ক্রেতা বলেন, ‘সবই সিন্ডিকেটের দখলে। যেদিন আলুর দাম বাড়ে, সেদিন হঠাৎ করেই সব বাজারে বেড়ে যায়। আবার যেদিন তেলের দাম বাড়ে, সেদিনও সব বাজারেই একসঙ্গেই বাড়ে। কিন্তু বাড়তি দাম আর সহজে কমে না। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে ক্রেতারা অসহায়।’ একটি ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা দেলোয়ার আক্ষেপ করে বলেন, ‘শুধু দাম নির্ধারণই শুনছি, এর কার্যকারিতা দেখছি না। যদি কার্যকর করাই না যায়, তাহলে নির্ধারণ করার দরকারটা কী?’
কারওয়ান বাজারেই একটি অফিসে পিয়নের চাকরি করেন পঞ্চাষোর্ধ্ব সদরুল আমিন। তিনি বলছিলেন, ‘মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পাই। সে হিসাবে প্রতিদিন বেতন ৪০০ টাকা। পাঁচজনের সংসারে প্রতিদিন চাল লাগে ৩ কেজির বেশি। শুধু চাল কিনতেই যদি ২০০ টাকা চলে যায়, তাহলে তরকারি কিনব কী দিয়ে আর সংসারের অন্যান্য খরচ চলবে কীভাবে?’
সদরুল আমিন আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘খেয়ে, বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে গেছে। টিসিবির ট্রাকে কিছুটা কম দামে চাল, ডাল পাওয়া যায়। কিন্তু সবাই তো আর লাইনে দাঁড়াতে পারে না। তা ছাড়া সারা দিন অফিস থাকে, সন্ধ্যার পরে গিয়ে টিসিবির পণ্যও পাওয়া যায় না।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দৃশ্যমান মূল্যতালিকা টানানো থাকতে হবে। যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, শুক্রাবাদ, কারওয়ান বাজার ও পশ্চিম রাজাবাজার- এই পাঁচটি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, শুধু কারওয়ান বাজারের কিছু দোকান ছাড়া অন্যান্য বাজারের দোকানগুলোতে কোনো দৃশ্যমান মূল্যতালিকা নেই। বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, তারা সারা দেশেই নিয়মিত বাজার তদারকি করছে। প্রতিষ্ঠানটির গণসংযোগ দপ্তর থেকে জানানো হয়, ৮ই নভেম্বরও অভিযান পরিচালনা করে ৭৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ঢাকার কারওয়ান বাজার, মালিবাগ রেলগেট বাজার ও জুরাইন বাজারে উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে এই অভিযান চলে। সংস্থাটি দাবি করে, আলু, চাল, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, আদাসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করা হয়। এ ছাড়া পণ্যের মূল্যতালিকা প্রদর্শন না করা, মূল্যতালিকার সঙ্গে বিক্রয় রসিদের গরমিল, পণ্যের ক্রয় রসিদ সংরক্ষণ না করা, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও পণ্য, নকল পণ্য, ওজনে কারচুপিসহ ভোক্তাস্বার্থবিরোধী কাজের জন্য এসব জরিমানা করা হয়।