বন্যায় আমনের সব শেষ পাটের ক্ষতি জানে না কৃষি বিভাগ

করোনা পরিস্থিতির কারণে কৃষক এবার সবজি আবাদে মার খেয়েছেন। মৌসুমি ফল চাষেও ভালো দাম পাননি। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতির রেশ কৃষক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এর মধ্যে বন্যার ধাক্কা কৃষকের জন্য সামলে ওঠা কঠিন হবে।

|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||

লম্বা সময় ধরে বন্যা থাকায় ব্যাপক ক্ষতিতে পড়েছে সারাদেশের কৃষক। বিশেষ করে আউশ-আমন আর পাটের আবাদ তলিয়ে গেছে পরপর দুই দফা বন্যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বন্যায় ৩৮টি জেলার ১ লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমির ১৪ ধরনের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে আউশ ও আমন ধানের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি।

কৃষিসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাঠে থাকা আউশ ধানের অনেক জমি বন্যায় ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হয়ে গেছে আমনের বীজতলা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, আমন মৌসুমের জন্য ২ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে ১ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল। অন্যদিকে ১৩ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়ে গেছে। ফলে বন্যায় এ দুটি ফসলের উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিতে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে কৃষক এবার সবজি আবাদে মার খেয়েছেন। মৌসুমি ফল চাষেও ভালো দাম পাননি। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতির রেশ কৃষক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এর মধ্যে বন্যার ধাক্কা কৃষকের জন্য সামলে ওঠা কঠিন হবে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দ্বিতীয় ধাপের বন্যায়। এই ধাপে বোনা আমন ধানের ৫৬ হাজার ৩৬২ হেক্টর ও রোপা আমন ধানের ৮ হাজার ৭৫৪ হেক্টর জমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৩৫ হাজার ৮২১ হেক্টর জমির আউশ ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৯৩৮ হেক্টর জমির আউশ ও আমনের ক্ষতি হয়েছে। সেই সঙ্গে ৯ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে করা আমনের বীজতলা নষ্ট হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপের এ বন্যায় আউশ ও আমন ছাড়াও ২৬ হাজার ৯১৫ হেক্টর জমির পাট, ১১ হাজার ৮২১ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি, ১ হাজার ৪৯৭ হেক্টর জমির ভুট্টা, ১ হাজার ৮১৪ হেক্টর জমির তিল, ১ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমির আখসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এর আগে প্রথম পর্যায়ে ২৫শে জুন থেকে ৯ই জুলাই পর্যন্ত বন্যায় রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল জেলায় ১১টি ফসলের প্রায় ৭৬ হাজার ২১০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪১ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকা। মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৪ হাজার জন। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দ্বিতীয় ধাপে ৩৮টি জেলার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা না হলেও ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে।

ফরিদপুরে ক্ষতিতে ৬৩ হাজার কৃষক

শুধু ফরিদপুরেই ক্ষতিতে পড়েছেন জেলার ৬৩ হাজার কৃষক। তাদের ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল বিশেষ করে আমন চাষের সবটাই নষ্ট হয়ে গেছে বন্যায়। ফসল নষ্ট হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষিজীবীরা যাদের অন্য কোনো আয়ের পথ নেই।

স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় আউশ, আমন, বীজতলা ও সবজিক্ষেত মিলে ১৪ হাজার ৬৫৮ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৬৩ হাজার ৪২৫ জন কৃষক। এর বাইরে চরাঞ্চলের কলাবাগানসহ বিভিন্ন বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হযরত আলী জানান, ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। যদিও পাটের যা ক্ষতি হয়েছে তার কোন তথ্য স্থানীয় কৃষি বিভাগের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে পাটের ক্ষতি সম্পর্কে কৃষকরা জানিয়েছেন, পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তারা পাট কাটতে পারেনি। অনেক দিন ধরে পানিতে ডুবে থাকায় ওই পাট কাজে আসবে না বলে জানিয়েছেন অনেক কৃষক।

সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের গোলডাঙ্গী এলাকার হাফিজুর বলেন, “সংসার চালানোর চালের চাহিদা মেটানোর জন্য ছয় বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছিলাম। সব শেষ। একদিকে করোনাভাইরাসের কারণে আয়রোজগারের পথ বন্ধ, আরেক দিকে বন্যায় ক্ষতি হল। কিভাবে চলবে বুঝতে পারছি না।”

একইভাবে বন্যায় ক্ষতির কথা জানান অম্বিকাপুর এলাকার কৃষক বক্কার খান। তিনি বলেন, প্রতিবছর বর্ষায় ক্ষতি হয়, কিন্তু এবারের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। আমার ২০ বিঘা আমন, দুই একর পাট গত ২০ দিন হল পানির নিচে। এই ক্ষেত থেকে ফসল পাওয়ার কোনো আশা নেই।

নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের ‘৯০ শতাংশ প্লাবিত হয়ে ক্ষেত-খামার যা ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে’ বলে জানিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুস্তাকুজ্জামান।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার বলেন, নর্থচ্যানেল, ডিক্রির চর, অম্বিকাপুর, চরমাধবদিয়া ও আলীয়াবাদ ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকায় এখনও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এসব এলাকায় ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন