বন্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের বিদায় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

বন্ধ হচ্ছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব সব পাটকল। সবশেষ ২৫টি চালু পাট ও পাটসংশ্লিষ্ট কারখানাও বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী বলেছেন, শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা মিটিয়ে দেওয়ার পরে এগুলোকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে চালু করা হতে পারে। পাটকলগুলোকে লাভজনক করবার নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকলেও সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছেন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

স্বাধীনতাপরবর্তিতে পরিত্যক্ত ও এদেশীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করে এগুলোকে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিতে গঠন করা হয় বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন বিজিএমসি। সেই ধারাবাহিতকায় বিজিএমসির অধীনে পাটকলগুলো ফের চালু করা হয়। কিন্তু মিলগুলোর ব্যবস্থাপনায় অদক্ষ ও সরকারদলীয় লোকজনের আধিক্য তৈরি হয়। রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি ও অস্থিরতায় শুরু থেকেই অন্য অনেক রাষ্ট্রিক খাতের মত পাটখাতেও তৈরি করা যায়নি জবাবদিহিতা ও আর্থিক স্বচ্ছতা। ফলে দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের আখড়ায় পরিনত হয় লাভের খাত পাটশিল্প।

রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনা আর দুর্ণীতিকে আমলে না নিয়ে জনগনের করের টাকায় প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে চালু রাখা হয় এসব পাটকল। একসময়ে বিজিএমসির অধীনে ৭৬টি পাটকল থাকলেও বিভিন্ন সময়ে বিক্রি করে দেওয়ায় এই সংখ্যা এখন ২৫টিতে নেমে এসেছে। এর মধ্যে তিনটি পাটসহায়ক কারখানা। এ হিসেবে দেশে এখন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সংখ্যা ২২টি। এসব পাটকলে কাজ করছেন ২৫ হাজার শ্রমিক।

শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ব্যবস্থাপনা খরচ, কাঁচামাল ক্রয়ের মত খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা হলেও প্রতি বছরই লোকসান দিয়ে আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো।বিজিএমসির হিসাব বলছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরেও এ লোকসানের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা হতে পারে। এসব পাটকল চালু রাখতে গিয়ে গত এক দশকে পাটকলে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এমন পরিস্থিতিতে অব্যাহত লোকসানের দায় থেকে মুক্ত হতে একটি কর্মপরিকল্পনা করে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। এর একটি সারাংশ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হলে তাতে সই করে এটি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সরকারের ইতিবাচক সাড়া পেয়ে এরই মধ্যে এটি বাস্তবায়নে প্রস্তুতি শুরু করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার ২৫শে জুন এ নিয়ে প্রথম সভা করেছে মন্ত্রণালয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। সভায় পাটকল বন্ধের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও বন্ধ করতে কী কী করা যেতে পারে, সে নিয়ে আলোচনা হয়। এতে মূখ্য বিষয় হিসেবে আলোচনায় স্থান পায় ২০১৪ সালের পর থেকে অবসরে যাওয়া ন্যূনতম ছয় হাজার শ্রমিকের অবসর সুবিধা পরিশোধের বিষয়টি।

সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছাড়াও সচিবগণ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার মহাপরিচালক, বিজেএমসির চেয়ারম্যান প্রমুখ।

সভা শেষে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক গণমাধ্যমকে জানান, দেশের পাট খাতে ব্যক্তি খাতের অংশ এখন ৯৫ শতাংশ। মাত্র ৫ শতাংশ আমাদের সরকারি মিলগুলোর। ক্রমাগত লোকসান হবে, এত টাকা সরকারের দেয়ার ক্ষমতা নেই। শ্রমিকদেরও সবসময় আন্দোলন করে টাকা আদায় করতে হয়। নয় হাজার কর্মী আছেন, যারা পেনশনের টাকা পাননি। তাদের প্রথম কিস্তিতে টাকা দেয়া হবে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রথম কিস্তি দেয়া হবে। করোনা না হলে আমরা পুরোটাই দিতে পারতাম। এখন পার্ট বাই পার্ট দেব। অবশ্যই তারিখ বলে দেব। আমরা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে দিতে চাচ্ছি।

আগে মিলগুলোকে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমরা বিক্রি না করে জুট মিল রাখব। এমন ম্যানেজমেন্ট দেব যাতে লোক ছাঁটাই না হয়। এ শ্রমিকরা এখানেই চাকরি পাবেন, কারণ দক্ষ কর্মী ছাড়া মিল চালাতে দেয়া হবে না। মিলগুলো বুঝে পাওয়ার পর টেন্ডার হবে। যে বেশি দেয় তাকে দেয়া হবে। কিন্তু তাকে অবশ্যই পাটকল পরিচালনায় দক্ষ হতে হবে। দক্ষ না হলে সে কাজ করবে না। জমি নেয়ার চেষ্টা করলে সেটা আমরা দেব না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বঙ্গবন্ধু পাটের জন্য আন্দোলন করেছেন, সুতরাং পাটকে আমাদের রাখতে হবে। পিপিপির মাধ্যমে জুট মিল থাকবে, এটা ডিসাইডেড।”

উল্লেখ্য, সবশেষ দেশের সবথেকে বড় পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেওয়ার পর কয়েক বছর আগে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারিগরি সহায়তা নিতে চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান চায়না টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশন ফর ফরেন ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল করপোরেশনের (সিটিইএক্সআইসি) সঙ্গে সই হয় একটি সমঝোতা চুক্তি।

পাটকলগুলোর অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলবার পর সিটিইএক্সআইসি জানায়, এসব মিলের বিদ্যমান পুরনো যন্ত্রপাতি সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না। এর সবই বদলাতে হবে।

সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পিপিপির ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল পরিচালনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করেছে সিটিইএক্সআইসি।

৬ thoughts on “বন্ধ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের বিদায় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন