চারু হক
আরাকান আর্মি নামের এক ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী বরাবরের মতো একটা চালের চালান লুট করেছিল। কিন্তু তাদের যখন জানানো হলো, এ চাল গৃহহীন মানুষের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, বিবেকের তাড়নায় সে চালগুলো তারা ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ, বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশে দেখছি, সামান্য কিছু দরিদ্র মানুষের জন্য যে ছিটেফোটা ত্রাণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সেগুলোও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।
‘সভ্য’-‘অসভ্য’, উন্নত ও অনুন্নত নির্বিশেষ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে করোনার মতো অভাবিত সংকট মোকাবেলায় সরকারি ও বিরোধিদল একযোগে, পরস্পর সহযোগিতার সূত্রে মাঠে নেমেছে; কিছু দেশে বিরোধি দলের নেতৃবৃন্দকে সংশ্লিষ্ট নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে তারা পরস্পর দোষারোপের সেই পুরনো বৃত্তেই আটকে রয়েছে, বরাবরের মতোই কাদা ছোড়াছুঁড়ি অব্যাহত রাখা হয়েছে।
বিশ্বের প্রায় দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসাকে গৌণ রেখে মানুষের এ সংকটে মানবিকতা দেখানোকেই পাথেয় বিবেচনা করছে। আইসোলেশনে থাকা মানুষের সেবায় কী করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া যায়, কীভাবে নিজেদের লাভ না করে মানুষকে সহায়তা করা যায় সে চেষ্টা চলছে। অথচ হরিলুটন্নয়নের বাংলাদেশে দেখছি ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতো পণ্য মজুদ অব্যাহত রেখেছে।
বিশ্ববাজারে যেসমস্ত পণ্যের দাম এমনকি তিন ভাগের একভাগে নেমে এসেছে, সেগুলোও তারা বরং বাড়তি দামে বিক্রি করছে। জীবনমরণের এ সংকট কালেও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হচ্ছে এইসব অবিবেচক ব্যক্তিদের নিবৃত্ত করতে।
মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুযমের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে, মানুষকে করোনা থেকে মুক্ত করতে সারাবিশ্বের ডাক্তার ও নার্সরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট উপকরণের অভাবে উন্নত বিশ্বের ডাক্তারদেরকে পর্যন্ত মাথায় পলিথিন বেঁধে মানুষকে সেবা করতে দেখা যাচ্ছে। মেডিক্যাল প্রফেশন থেকে অবসর নেওয়া হাজার হাজার মানুষ মানুষের সেবায় চিকিৎসা ভার তুলে নিয়েছে। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যিনি রাজনীতিতে আসার আগে ডাক্তারি চর্চা করতেন, তিনি এই ক্রান্তিকালে পুনঃনিবন্ধন করে মানুষের সেবায় চিকিৎসায় নিযুক্ত হয়েছেন। অথচ বাংলাদেশের চিকিৎসকদের বিরাট অংশকেই দেখা যাচ্ছে নানান অজুহাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সিভিল সার্জনদের তাদের অফিস ফাঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে। সংক্রমণের অহেতুক শঙ্কায় করোনা আক্রান্ত তো আছেই, এমনকি সাধারণ রোগীদেরও চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যুবরণে বাধ্য করা হচ্ছে।
ভারতের পুঁজিপতি আদম প্রেমজির মতো ধনকুবের মানুষের মঙ্গলে মুক্তহস্তে ৫০ হাজার কোটি রুপি দান করেছেন। ব্যতিক্রম বাদে সমস্ত বিশ্বের ধনকুবেরগণ মানুষের জন্যে মুক্তমনে খাদ্য ও চিকিৎসাসহ বহুমুখী সহায়তার দ্বার উন্মুক্ত করছেন। অথচ, লুম্পেন পুঁজিবাদের দেশ বাংলাদেশে দেখছি স্কয়ার বা বেক্সিমকোর মতো দানবীয় গ্রুপগুলো অত্যাবশ্যক ওষুধের দাম বাড়িয়ে সেখান থেকে ৫০০ কোটি ব্যবসা নিশ্চিত করে বড়জোর ৫০ কোটি দান হিসেবে তুলে দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। যে তহবিলের টাকা আদৌ উদ্দিষ্ট মানুষের কাছে পৌঁছবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ করার অনেক কারণ ও নজির আছে। এবং এই একই দৃষ্টিকোণের দরুন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাক্ষস গ্রুপ বা সবচেয়ে পয়সাওয়ালায় পরিণত হওয়া বসুন্ধরা গ্রুপকে দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কিত প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজকে ভূয়সী প্রশংসা করতে। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসায় পদক্ষেপবিহীন এই জিনিস নাকি ‘বিশ্বসেরা’ হয়েছে !
ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মতো রাষ্ট্র এতসব সুযোগ সুবিধা ও সংস্থান সত্ত্বেও কী পরিমাণ অসহায় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সবাই জানে। এমত অসহায়ত্ব সহনীয় করতে পাকিস্তান কিংবা পশ্চিম বঙ্গের মতো রাজ্য, যাদের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা ও উন্নয়নের অহমিকা বাংলাদেশের চাইতে অনেক নিচু- তারা তাদের জনগণের স্বার্থে কী করছে এটাও সবাই জানে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের সরকার, এ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সর্বেসর্বা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কী পদক্ষেপ নিয়েছে বিশেষকরে মানুষের খাদ্য সংস্থান এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে।
জানুয়ারি থেকে করোনা মোকাবেলায় জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ টাইপের দাবির মতো জঘন্য মিথ্যাচার, এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাতে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়ার মতো আত্মঘাতী অবস্থান দেশের সমস্ত মানুষকে ভয়াবহ এক পরিণতির দিকে ধাবিত করেছে। এবং এরইমধ্যে বা এইসব অস্তিত্ববিনাশী অবিমৃশ্যকারিতার অংশ হিসেবেই দেখা যাচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোর লোকজন তাদের চিয়ারত দুর্নীতির ঐতিহ্য অটুট রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্রণোদিত হয়ে বেশকিছু মানুষ কেউ চাঁদা তুলে বা নিজেদের পকেট থেকে চিকিৎসা সামগ্রী পাঠাচ্ছে, কেউ কেউ স্বল্পমূল্যে এসমস্ত অত্যাবশ্যক জিনিস আমদানির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে- কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি চক্র তাদের কমিশন না পাওয়ায় এগুলোর সঠিক সংস্থানে সহায়তা করছে না, এসমস্ত জিনিস মানুষের সেবায় ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে না।
ইনোভেটিভ ক্ষমতাসম্পন্ন মানবপ্রেমী একটি গ্রুপের কথা জানি, যাদের একটা প্রাযুক্তিক আবিষ্কার করোনা কিংবা এরকম যেকোন সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসায় ট্র্যাকার হিসেবে ভূমিকা রাখবে। এসমস্ত অসুখ ধরা পড়া কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিরা তাদের জন্য বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কোথায় কোথায় যাতায়াত করে সেটা এই সফটওয়্যার দিয়ে ধরা যাবে, এবং সেই সাথে সতর্কতা হিসেবে আশাপাশের ব্যক্তিদের কাছে এসএমএস পৌঁছে যাবে। ফলে কোনও রোগীকে টানাহেঁচড়া বা পুলিশ দিয়ে হেনস্তা করতে হবে না, বরং কেউ কোয়ারেন্টিন না মানলে সহজেই কেউ তথ্য দিতে পারবে সংশিষ্ট সিভিল সার্জন বা ডিসি অফিসে।
ওয়ানস্টপ প্লার্টফর্ম হিসেবে কাজে লাগিয়ে এখান থেকেই সচেতনতামূলক বার্তা বা নির্দেশনা পৌঁছে দেয়া যাবে দেশের সবখানে, সকলের কাছে। অথচ একদল তরুণের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই প্রযুক্তিটা নানবিধ কুযুক্তি দিয়ে অর্থাৎ কমিশন না পাবার কারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাস্তবায়ন করছে না। অর্থাৎ সরকারের সবচেয়ে শক্তিমান এই চক্রটা নাগরিকের সহায়তায় নিজেদের নিবৃত্ত রেখেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা স্বপ্রণোদিত সেবাকামী মানুষকেও জনসাধারণের সহায়তা করতে দিচ্ছে না।#
চারু হক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী, সদস্য রাষ্ট্রচিন্তা
