দখল আর দূষণে অতিষ্ঠ খুলনার ময়ূর নদী

আবারও দখল আর দূষণে প্রাণ হারাচ্ছে খুলনার প্রাণ ময়ূর নদী। অভিযান চালিয়েও কোনভাবেই দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না এই নদী।

|| সারাবেলা প্রতিনিধি, খুলনা ||

আবারও দখল আর দূষণে প্রাণ হারাচ্ছে খুলনার প্রাণ ময়ূর নদী। অভিযান চালিয়েও কোনভাবেই দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না এই নদী। নদী বাঁচাতে পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপসহ একে সবার নদী হিসেবে সচল করতে বাংলাদেশ নদী কমিশনের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে খুলনার পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চ। গত ১৪ই জানুয়ারি সংগঠনের আহবায়ক অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা ও সদস্য সচিব সুতপা বেদজ্ঞ এই চিঠি পাঠান।

এদিকে নদীর দেখভালের দায়িত্বে থাকা খুলনা সিটি কর্পোরেশন কেসিসির উচ্ছেদ টিমের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানান, বারবার দখলমুক্ত করেও ঠেকানো যাচ্ছে না দখলবাজদের। তবে নদীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে শিগগিরই মেয়রকে জানানো হবে। এবং মেয়রের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছে কেসিসিসংশ্লিষ্টরা।

ছবি: সংগৃহিত

নদী কমিশনের চেয়ারম্যানকে ই-মেইলে পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়, বটিয়াঘাটার রূপসা নদী থেকে হাতিয়া নামে উৎপত্তি ময়ূরের। এরপর খুলনা মহানগরীর পশ্চিম কোল ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে পুটিমারী ও তেতুলতলা গ্রামের মাঝ দিয়ে গল্লামারী ব্রিজ থেকে শুরু হয়েছে ময়ূর নদী নামে যাত্রা। এটি সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশ দিয়ে রায়েরমহল হয়ে বয়রা জেলেপাড়া বাজারের পাশ ঘেসে লতা পাহাড়পুর (দেয়ানার শেষ সীমানা) গিয়ে খুদিয়ার খাল নামে বিল ডাকাতিয়ায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৪২ কিলোমিটার (কমবেশী), প্রস্থ স্থান ভেদে ৩০ থেকে ১১০ ফুট এবং গভীরতা স্থান ভেদে ১০ থেকে ২৪ ফুট।

একসময়ে ময়ূর নদী এখানকার মানুষের জীবন প্রবাহের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মূল ভূমিকা পালনকারী এই নদী ছিল এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। নৌকা-ট্রলার করে সুন্দরবন থেকে আনা গোলপাতা, গরানসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি এই নদী দিয়ে আসতো এই শহরে।

নদীর আশ-পাশে বসবাসকারী মানুষেরা চাষাবাদের কাজে এই নদীর পানি ব্যবহার করতেন। যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলত। সুবিধাবঞ্চিত এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ গোসল থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজে এই নদীর পানি ব্যবহার করতেন। এমনকি পানীয় জলের চাহিদাও মেটানো হত এই নদী থেকে। এলাকার শ্রমজীবী মানুষেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

বর্তমানে ময়ূর নদীর আশীর্বাদপুষ্ট মানুষেরাই এখন নদীটিকে অভিশপ্ত করে তুলেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী এ জলাধারের দু’পাশের অবৈধ দখলকারীরা নদীর অংশবিশেষ ভরাট করে বসতবাড়ী পর্যন্ত গড়ে তুলেছে। অবৈধভাবে শতশত বিঘা এলাকা ঘিরে করছে মাছের চাষ। নদীর দু’পাশে অসংখ্য ঝুলন্ত পায়খানা নদীটি ব্যবহারের অযোগ্য করে তুলেছে।

ছবি: সংগৃহিত

এদিকে নদীর প্রবাহ সচল রাখতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত স্লুইজ গেটটি প্রায় অকার্যকর। এটি সচল থাকলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, তদারকীর অভাব এবং দায়িত্বশীলদের অসততার কারণে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। নদীর দু’পাড়ের ময়লা-আবর্জনায় নদীর গভীরতা আগের থেকে অর্ধেকে এসে পৌঁছেছে। পানি পঁচে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে। পানি উঠানো নামানোর জন্য মাঝে মাঝে গেট যেটুকুও খোলা হয় প্রভাবশালীরা মাছ ধরার জন্য ওয়াপদার সরকারি গাছের ডালপালা কেটে নদীতে ফেলে কমর তৈরী করে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে নদী ভরাটের কাজ আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে।

মূলত: ময়ূর নদী সংরক্ষণে গত ২০০১ সাল থেকে এলাকার সচেতন জনগোষ্ঠী কথা বলে আসছে। তারই প্রেক্ষিতে গত ২০০২ তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ময়ূর নদী পরিদর্শন করেন। তিনি ময়ূর নদী সংরক্ষণের আশ্বাস দেন। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যেই বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হওয়ায় সেই সংরক্ষণের আশ্বাসটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে ময়ূর নদী সংরক্ষণের আন্দোলন অব্যাহত থেকেছে। নদী সুরক্ষায় বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়নসংস্থা, সহযোগী সংস্থা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ বিভিন্ন পর্যায়ে এই নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কাজ করে আসছে ধারাবাহিকভাবে।

সর্বশেষ খুলনা জেলা প্রশাসন ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে গত ২০০৯ সালে সরকারি প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি প্রায় এক মাস ময়ূর নদীসহ বাইশখাল তদন্ত শেষে সমন্বয় কমিটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি প্রতিবেদন দেয়। সেই প্রতিবেদনে দখলদারীদের তালিকা, সমস্যা ও সংরক্ষণে করণীয় বিষয় উল্লেখ ছিল। পরবর্তীতে এই প্রতিবেদনের বিপরীতে খুলনা সিটি কর্পোরেশন ময়ূর নদী ও বাইশ খাল সংরক্ষণে একটি প্রকল্প নেয়া। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়ন মাঠ পর্যায়ে পরিবেশ দুর্যোগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ছবি: সংগৃহিত

মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে, সকল সংযোগ খালগুলিকে সংকুচিত করে তার পাড় বেঁধে ড্রেনে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। তার চেয়ে বড় সংকটের বিষয় সেই খালগুলির তলদেশও পাকা করে দেয়া হচ্ছে, যার ফলে পানি রিচার্জ হওয়ার কোন সুযোগ থাকছে না। যদিও তলদেশে একটু দূরে দূরে ছোট ছিদ্র করে দেয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। এর ফলে এলাকায় জলাবদ্ধ প্রবণতা বেড়েছে। এই অঞ্চলের অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি এই সকল সংযোগ খালগুলি দিয়ে ময়ূর নদী হয়ে নিষ্কাশিত হওয়ার স্বাভাবিক নিয়ম ব্যাহত হচ্ছে।

সংগঠনের সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে দেখেছে, এখনো নদী দখল করে স্থাপনা তৈরী হচ্ছে। নদী সংশ্লিষ্ট খাল দখল করে প্রভাবশালীরা মাছ চাষ করছে। মাছ ধরার জন্য কমর তৈরী করে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করায় নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া তরান্বিত হচ্ছে।

জোয়ার ভাটা স্বাভাবিক না থাকার কারণে জোয়ারের পানির সাথে পলি না আসায় কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে। এবং দিন দিন ফলন কমে আসছে। গরীব চাষীরা প্রয়োজনে পানি পাচ্ছে না। কখনও কখনও ৫/৭ হাজার টাকার বিনিময়ে গেট খুলে পানি তুলতে হয়। গেটম্যান সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। ফলে অতিবৃষ্টির সময় গেট খুলে পানি বের না করায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। নদীর দু’পাড়ের বিরাট অংশের ধানের ফলনের খুব ক্ষতি হয়। শহরেও জলাবদ্ধতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রভাবশালীমহল সময় মত পানি না দিয়ে এবং জমিতে পলি উঠতে বাধা সৃষ্টি করে জমির ফলন কমিয়ে অল্প দামে গরীব কৃষকের নিকট থেকে জমি কেনার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।কখনও কখনও পানির চাপ কমানোর জন্য জোয়ারের সময় গেট বন্ধ রাখা প্রয়োজন। কিন্তু এলাকায় স্বার্থান্বেষীমহল গেটম্যানের যোগসাজশে জোয়ারের সময় গেট খুলে জাল পেতে মাছ ধরে থাকে।

ছবি: সংগৃহিত

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারী না থাকায় নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ঝুলন্ত পায়খানা, ফলে পানি দূষিত হচ্ছে। নদীর যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় এর সাথে মুক্ত ড্রেনের পানি নিস্কাশন না হওয়ায় শহরে জলাবদ্ধতা তৈরী হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সুযোগে নদীর পাড়ে বসবাসকারী অসচেতন মানুষেরা বর্জ্য ফেলে পানি দূষিত করছে ও নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ভূ-প্রকৃতি অনুযায়ী খুলনা মহানগরী পশ্চিম দিকে ঢালু। অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মে পানি পশ্চিম দিকেই প্রবাহিত হবে। প্রকৃতির এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখতে ময়ূর নদী ও তার সংযোগ বাইশটি খাল উদ্ধার এবং সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্পের মাধ্যমে এই জলাশয়গুলো বেঁধে না রেখে সেগুলোকে অবমুক্ত করে অবাধ পানি প্রবাহ সৃষ্টি করা খুবই জরুরী বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

সংবাদ সারাদিন