|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনের আট বছরেও কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি শ্রমিকরা। ঘটনায় আহত শ্রমিকদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, কর্মক্ষমতা হারিয়ে বেকার জীবনযাপনে নিজেদের চিকিৎসার খরচও মেটাতে পারছেন না অনেকেই। ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর রাতে সাভারের আশুলিয়ায় নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের মালিকানাধীন তাজরীন ফ্যাশনসে স্মরণকালের ভয়াবহ আগুনে অন্তত ১১২ জন শ্রমিক মারা যান। আহত আর দগ্ধ হয়ে বেঁচে আছে শতাধিক শ্রমিক।
মঙ্গগলবার তাজরীন ফ্যাশনস গার্মেন্টসের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা রাজধানীতে তিন দফা দাবিতে ‘জিন্দা লাশের’ মিছিল নিয়ে গণভবনের দিকে যেতে চাইলে তাতে বাধা দেয় পুলিশ। এক পর্যয়ে পুলিশ মারমুখী হয়ে শ্রমিকদের উপর চড়াও হয়। বাধে সংঘর্ষ। বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা রাস্তায় শুয়ে পড়েন। এরআগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি গণভবনের দিকে যাত্রা শুরু করলে কদম ফোয়ারার সামনে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়া পুলিশ। এই মিছিলের আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শ্রমিকরা। সমাবেশে আহত শ্রমিকদের সম্মানজনক ও বাস্তবসম্মত ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ তিন দফা দাবি জানানো হয়।

এদিকে শোকাবহ এই দিনে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাজরিন গার্মেন্টেসে নিহত শ্রমিকদের স্মরণ করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল নয়টা থেকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে কারখানার প্রধান ফটকে উপস্থিত হন আহত শ্রমিকরা। সেখানে নিহতদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে এক মিনিট নিরবতা পালন ও তাদের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া করা হয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আহত শ্রমিকরা বলেন, ঘটনার পর পর তাদের যে অনুদান দেয়া হয়েছিল তা ছিলো খুবই কম।
হতাহতদের স্বজনরা ছাড়াও গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি, টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পোশাক-শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স টেইলার্স লীগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও নীরবতা পালন করা হয়। এসময় স্বজনরা জানান, গতকাল আট বছর পার হলেও নিহত শ্রমিকদের পরিবার ও আহত শ্রমিকরা পাননি কোনো ক্ষতিপূরণ। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও অবিলম্বে এ ঘটনায় করা মামলা নিষ্পত্তির দাবি জানান তাঁরা।



শ্রদ্ধাশেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা বলেন, তাজরিন ট্র্যাজেডির আট বছর পূর্ণ হলেও এখনো পর্যন্ত আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা হয়নি, শ্রমিকদের পুনর্বাসন করা হয়নি, যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি এবং তাজরিন ফ্যাশনের মালিকসহ দোষীদের বিচারও শেষ করা হয়নি। ওই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে ১১৭ শ্রমিকের প্রাণহানি ছাড়াও তিন শতাধিক শ্রমিক আহত হন। আহতদের অনেকেই হারিয়েছেন তাঁদের কর্মক্ষমতা। এখন তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দেশের ইতিহাসে শতাধিক শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রথম।
আট বছর ধরে ক্ষতিপূরণের আশায় থাকা রেহেনা বেগম বলেন, আহত হওয়ার পর নারী ও শিশু হাসপাতালে বেশ কয়েক মাস চিকিৎসা নিয়েছি। তখন তো আমার কোনো টাকা-পয়সা লাগেনি। এখনও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা করে। মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছি। কিছুদিন পর পর হাসপাতালে যেতে হয়, কিন্তু চিকিৎসার জন্য খরচ করার মত কোনো অর্থ আমার নেই। সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতিচারণ তিনি বলেন, “আমি ছিলাম পাঁচতলায়, দেখি সবাই দৌড়াদৌড়ি-কান্নাকাটি করছে। আমিও দৌড়ে কিনারে এসে লাফ দিয়ে দোতলায় পড়ি।এতে পায়ের ভেতরে রড ঢুকে যায়। হাতপায়ে প্রচণ্ড আঘাত পাই। এরপর বহুদিন কয়েকটি হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। খরচ চালাতে বাবার সম্পত্তি থেকে পাওয়া তিন শতক জমি বিক্রি করেছি। এখন বিনা চিকিৎসায় আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার টাকা-পয়সার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কিছুই পাইনি। বিভিন্ন সময় শ্রমিক সংগঠনগুলো ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষকেই ছাড় দিতে নারাজ’ বলে আসলেও এখন পর্যন্ত আহত শ্রমিকদের অভিযোগের সুরাহা হয়নি।



কিছু টাকা-পয়সা’ পাওয়ার আশায় এদিন আতাহারুল ইসলামও যোগ দেন মানববন্ধনে। স্ত্রী সাহেরা বাবু ঘটনার দিন বেঁচে ফিরে আসতে পারলেও মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে এখন অনেকটা অপ্রকৃতস্থ বলে জানান তিনি। আতাহার বলেন, তাজরীন ফ্যাশনসের পেছনে একটি টিনের ঘরে তারা থাকেন। ঘর থেকে তার স্ত্রীর বের হওয়ার মত অবস্থা নেই। মাঝে মাঝে ঘরের লোকদেরও চিনতে পারে না। সাহেরা ও আতাহারের সংসারে আছে শিশু দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আতাহার একটি গার্মেন্টে কাজ করছেন। তবে একার আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে।
মঙ্গলবার প্রেস ক্লাবের সামনে তাজরীন ফ্যাশনসের আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণে দাবিতে মানবন্ধনের আয়োজন করে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন। সংগঠনটির আহ্বায়ক বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, তাজরীন ফ্যাশনসের আগুনের সাত বছর শেষ হয়ে আট বছরে পা দিলো। এই সময়ের মধ্যে বহু এনজিও আহত শ্রমিকদের নিয়ে অনেক খেলেছে। সেই ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিহত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে বলে বলেছিলেন। আহতদের মধ্যে মাত্র ১৭৪ জন সামান্য অংকের টাকা পয়সা পেয়েছে। এখনও শত শত আহত শ্রমিক কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।”



আগুনের ঘটনার পর শ্রমিকদের অভিযোগ ছিল, আগুন লাগার পরও কারখানার ছয়টি ফ্লোরের কয়েকটিতে দরজা আটকে রাখা হয়েছিল, শ্রমিকদের নিচে নামতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া ওই কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারত বিধি অনুসরণ না করা এবং অবহেলারও প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব অভিযোগে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী মাহমুদাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। তদন্ত করে ১৩ মাস পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির পরিদর্শক এ কে এম মহসীন উজ জামান খান। অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়।
মামলার অপর আসামিরা হলেন- প্রতিষ্ঠানটির লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও শহীদুজ্জামান দুলাল।