|| সারাবেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ ||
অবাধে টপসয়েল বিক্রি করায় পাল্টে যাচ্ছে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কসবা গ্রামের ফসলি জমির ধরণ। জমির মালিকেরা তাঁদের জমি ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীরা ফসলি জমির উপরিতল কেটে সেই মাটি বিক্রি করছেন ইটভাটার মালিক ও রাস্তার ঠিকাদারদের কাছে। নির্বিচারে জমির টপসয়েল বিক্রি করায় সমতল জমিতে তৈরি হচ্ছে খাদ। স্থানীয়দের আশঙ্কা এভাবে জমির টপসয়েল কাটতে থাকলে ফসলি মাঠ পরিণত হবে খাল-বিলে।
গেলো ৬ থেকে ৭ বছর ধরেই এভাবে চলছে টপসয়েল কাটার কারবার।এতে করে মাঠের অনেক জমির শ্রেণি পাল্টে গেছে। ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধের জন্য ভূমি অফিস, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে বারবার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/20210104_122502-300x169.jpg?resize=1200%2C676&ssl=1)
সরেজমিনে কসবা গ্রামে ফসলি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের ফসলি মাঠটির ৬/৭টি স্থানে বিশাল অংশজুড়ে দুই/তিন ফসলি জমির মাটি গভীর করে মাটি কাটার কাজ চলছে। প্রতিটি স্থানেই এক সঙ্গে ৫-৬ টি ট্রাক্টর এসে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। অবাধে ট্রাক্টর চলাচল করায় সাগরপুর থেকে কসবা গ্রাম পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার পাঁকা সড়কটি প্রায় নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।
সাগরপুর গ্রাম থেকে ৫ থেকে ৬শ গজ দূরে কসবা ফসলি মাঠে নেমে দেখা গেল, সেখানে ৪-৫ বিঘা জমিজুড়ে গভীর করে মাটি কেটে ট্রাক্টরে তোলা হচ্ছে। প্রতি ট্র্যাক্টর মাটি ২৫০ টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। জমি থেকে গভীর করে মাটি কাটায় সেটি এখন খালে পরিণিত হয়েছে। ইটভাটা ও রাস্তার কাজে সেখান থেকে ফের মাটি কাটায় আশপাশের উচুঁ জমিগুলো ধসের হুমকিতে রয়েছে।
এক ট্রাক্টরচালক বলেন, আমার বাড়ি কসবাতেই। জমির মালিক তার জমিটি এক ব্যক্তিকে ইজারা দিয়েছেন। ইজারাদারেরা প্রতি ট্রাক্টর মাটি ২৫০ টাকা দাম নিচ্ছে। রাস্তার ঠিকাদার ও ইটভাটার মালিক প্রতি ট্রাক্টর মাটি সাড়ে ৬শ টাকায় কিনছেন। প্রতিদিন গড়ে একটি ট্র্যাক্টর ১০ থেকে ১৫ টি ট্রিপ দিচ্ছে। মাটি কাটতে গিয়ে বরেন্দ্রর ডিপ টিওবয়েলের আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রায় ১২০ থেকে ১৬০ ফুট পাইপ ফেটে যাওয়ায় তা তুলে রেখেছে ইজারদাররা।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/download-1.jpg?resize=1200%2C674&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/download-1.jpg?resize=1200%2C674&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/download-1.jpg?resize=1200%2C674&ssl=1)
কসবাগ্রামের পচাঁর মোড়ে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির পাশ থেকে গভীর করে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটির পাশের মাটি আলগা করায় সেটি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। মাটি কেটে নেওয়ার কারণে সেই স্থানটি খালে পরিণিত হয়েছে। উঁচুতে থাকা বসত বাড়িগুলো মাটি ধসের হুমকিতে রয়েছে। খুঁটির পূর্বদিকে ২০ গজ দুরুত্বে মাসুদ নামের এক ব্যক্তি তাঁর বিশাল অংশের কলা বাগানটি এক ব্যক্তির কাছে মাটি কাটার জন্য ইজারা দিয়েছেন। সেই ব্যক্তি প্রায় ৫ থেকে ৬ফিট গভীর করে মাটি কেটে হাসু ও বাবুর ইট ভাটায় বিক্রি করছে।
কসবা, সাগরপুর ও পচাঁরমোড়ের গ্রামবাসীরা জানান, বিগত ৬/৭ বছর আগে থেকে কসবা ফসলি মাঠ থেকে মাটি বিক্রির শুরু হয়। ৫-৬ জন জমির মালিক তাঁদের জমির বালু ও মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীরা দুই/তিন ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটার মালিক ও রাস্তার ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করছেন। আর প্রতিদিন গড়ে ২-৩ শ ট্রাক্টর বালু ও মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে এই মাঠ থেকে। গভীর করে মাটি কেটে নেওয়ার কারণে উচুঁ ফসলি জমি ধসে পড়ছে। এখন পুরো মাঠজুড়ে ৬-৭টি স্থানে মাটি কাটার কাজ চলছে। অবাধে ট্র্যাক্টর চলাচল করায় গ্রামের সড়কটি নষ্ট হয়েছে।
ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি বন্ধ করতে তাঁরা ইউনিয়ন ভূমি অফিস, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু একাধিক জনপ্রতিনিধি ইটভাটা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁরা কোন ব্যবস্থা নেননি। ইটভাটার মালিকদের স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। ফলে ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের বিষয়টি নজর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
ওই এলাকার বাসিন্দা সবুজ , সোহেল, জাহিদ , মুনজুর ও আরমানসহ বেশ কিছু ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফসলি জমি কেটে মাটি বিক্রি বন্ধের জন্য ভূমি অফিস, ইউএনও অফিস ও ইউনিয়ন পরিষদ সবখানে গেছি। কিন্তু কেউ মাটি কাটা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়নি। আমরা গরীব মানুষ আমাদের জমিজমা ধসে গেল কারও কিছুই যায় আসে না।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/download.jpg?resize=1200%2C687&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/download.jpg?resize=1200%2C687&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/download.jpg?resize=1200%2C687&ssl=1)
কসবাগ্রামের বাসিন্দারা বলেন, গত ২০১৫ সালে র্যাব সদস্যরা এসে কসবা পচাঁর মোড়ে ট্রাক্টরসহ মাটি উত্তোলনকারীকে ধরেছিল। তারপরও এখানে মাটি কাটার কাজ বন্ধ হয়নি। একই গ্রামের হরিপদ বলেন, ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি দেওয়ায় মাঠের অন্য জমিগুলো ধসের সৃষ্টি হয়েছে। অবাধে ট্রাক্টর চলাচল করায় গ্রামের সড়কটি নষ্ট হয় গেছে। সড়কটি দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করা যাচ্ছে না। ইউএনও, স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যানকে তাঁরা ঘটনাটি জানিয়েছেন।
ছালাম নামের এক বালু ও মাটি ব্যবসায়ী বলেন, জমিতে ফসল হয় না। তাই জমির মালিক আমাদের কাছে জমির মাটি বিক্রি করছেন। এতে ফসলের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ভূমি অফিস সুত্রে জানা যায়, কোন জমির মালিক নিজ ইচ্ছে মতো জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে পারবেনা। কেউ নিজ ইচ্ছে মতো জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বদলগাছী উপজেলা কৃষি অফিসার হাসান আলী বলেন, ফসলি মাঠে জমির উর্বর মাটি কেটে বিক্রি দেওয়ায় অন্য জমিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জমির শ্রেণিও পরিবর্তন হচ্ছে। আমি বিষয়টি আমার উদ্ধর্তন কতৃপক্ষকে জানিয়েছি।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/nawgong-1578326006386-300x185.jpg?resize=1200%2C740&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/nawgong-1578326006386-300x185.jpg?resize=1200%2C740&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/01/nawgong-1578326006386-300x185.jpg?resize=1200%2C740&ssl=1)
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বদলগাছী কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হারুনুর আর রশিদ বলেন, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সাগরপুর গ্রাম থেকে কসবা গ্রাম পর্যন্ত আটশ মিটার সড়ক পাঁকাকরণ করেছে। মাঠের মাটি উত্তোলন কাজে অবাধে ট্রাক্টর চলাচল করায় ও সড়কটি কেটে ট্রাক্টর নামা উঠা করায় সড়কটির বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি এর আগেও আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানিয়েছি। তবে ডিপটিওবয়েলের আন্ডারগ্রাউন্ড এর পাইপ ফেটে ফেলার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবো।
এবিষয়ে বদলগাছী সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুমন জিহাদীর সাথে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি গতরাতেই শুনেছি আজ খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবো।
বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু তাহির বলেন, কসবা গ্রামে ফসলি জমির বালু ও মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে বলে আমি প্রথম শুনলাম। আইন অমান্যকরে বালু ও মাটি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।