চিকিৎসক-কর্মচারি না থাকায় বেহাল দশায় নাঙ্গলকোটে রাষ্ট্রিয় স্বাস্থ্যসেবা

গুরুত্বপূর্ণ ১৬জন চিকিৎসকের পদ শূণ্যসহ বেশ কিছু সংখ্যক কর্মচারীর শূন্যপদে নিয়োজন না হওয়ায় এলাকার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন দরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে।

|| বশির আহমেদ, নাঙ্গলকোট(কুমিল্লা) ||

চিকিৎসক ও কর্মচারি সংকটে বেহাল দশায় পড়েছে জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এতে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ১৬জন চিকিৎসকের পদ শূণ্যসহ বেশ কিছু সংখ্যক কর্মচারীর শূন্যপদে নিয়োজন না হওয়ায় এলাকার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন দরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে। জুনিয়র কনসালনেটন্ট ( এ্যানেসথেসিয়া) না থাকায় অপারেশন থিয়েটারটিও বন্ধ রয়েছে। এক্সরে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও অপারেটরের পদে লোক না থাকায় চালানো যাচ্ছে না এগুলোও।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক থাকলেও তাদের বসার ব্যবস্থা না থাকায় তৃণমূলের মানুষও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এতে করে প্রায় ৫ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এদিকে তৃণমুলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ১টি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক জরাজীর্ণ দশায় পড়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের গুরুত্বপূর্ণ জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), চক্ষু, ইএনটি, কার্ডিওলজি, অর্থ-সার্জারি, শিশু, চর্ম ও যৌন, এ্যানেসথেসিয়া, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার, সহকারি সার্জন ( এম ও ) ও এএমসি পদ শূণ্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সহকারি সার্জন একজন, গোহারুয়া ২০ শষ্যা হাসপাতালেও জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), সার্জারি ও এ্যানেসথেসিয়ার পদও শূণ্য রয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারির ১৯টি পদ শূণ্য থাকায় টিকাদান, ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন, সংক্রামণ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ, কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন ও স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ শূণ্য থাকায় হাসপাতালের সর্বত্র অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা বিরাজ করছে। বাবুর্চি ও সহকারি বাবুর্চির পদ শূণ্য থাকায় খাবার রান্না করার কেউ নেই। এ্যাম্বুলেন্স চালকের পদটিও শূণ্য রয়েছে।

এদিকে, উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা গোহারুয়ায় তৃণমূলের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ২০০৬ সালে স্থাপিত ২০শষ্যা হাসপাতালটি উদ্বোধনের গত ১৫ বছরেও পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা চালু করা সম্ভব হয়নি। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায়-দফায় হাসপাতালটি পরিদর্শন করলেও পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা চালু করা যায়নি। বর্তমানে বহির্বিভাগ চালু থাকলেও কোন ওষুধ বরাদ্দ নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন না থাকায় আন্তঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না। এছাড়া হাসপাতালটির সীমানা প্রাচীর, মূল ভবন ও আবাসিক ভবনগুলোর দরজা-জানালা না থাকা এবং দীর্ঘদিন থেকে পরিত্যাক্ত থাকায় হাসপাতালটির সর্বত্র ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, এক্সরে, ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনের অপারেটর, রেডিওলজিষ্ট, কার্ডিওগ্রাফার ও সনোলজিষ্টের পদ শূণ্য থাকায় মেশিনগুলো চালানো যাচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর রোগীরা এক্সরে, ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রামের সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এতে করে বেসরকারি হাসপাতালের দালালরা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া।

এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক, হিসাবরক্ষক, ক্যাশিয়ারের ১টি পদ, অফিস সহকারি কাম-কম্পিউটার অপারেটরের ৩টি পদসহ মোট ৬টি পদ শূণ্য থাকায় অফিসিয়াল কাজেও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ৩টি পদ শূণ্য থাকায় হাসপাতালের সর্বত্র অপরিচ্ছন্ন অবস্থা বিরাজ করছে। অফিস সহায়কের ৪টি পদের মধ্যে ৩টি পদ শূণ্য রয়েছে। রোগীদের খাবার রান্নার জন্য বাবুর্চি ও সহকারি বাবুর্চির পদ শূণ্য থাকায় খাবার রান্না করার কেউ নেই। সিকিউরিটি গার্ডের ২টি পদ বছরের পর বছর শূণ্য রয়েছে। ২য় শ্রেণীর নার্সিং সুপারভাইজার ০১জন, মিডওয়াইফ ০১জন, সিনিয়র ষ্টাফ নার্স ০২জন, ৩য় শ্রেণীর প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক, হিসাবরক্ষক, ক্যাশিয়ারের ১টি পদ, অফিস সহকারি কাম-কম্পিউটার অপারেটরের ৩টি পদ, পরিসংখ্যানবিদ, ষ্টোর কিপার, এস এ সি এম ও একজন, ফার্মাসিষ্ট ২জন, এম, টি ল্যাব, এম টি রেডিওলজি, ডেন্টাল, স্বাস্থ্য পরিদর্শক একজন করে, সহকারি স্বাস্থ্য পরিদর্শক একজন, স্বাস্থ্য সহকারির ১৯টি পদ, সহকারি নার্স ১জন, গাড়ী চালক ১জন, টিকেট ক্লার্ক ১জন, কার্ডিওগ্রাফার ও জুনিয়র মেকানিকের পদ শূণ্য রয়েছে। এছাড়া ৪র্থ শ্রেণীর ল্যাব এটেনডেন্ট ১ জন, অফিস সহায়ক ৩ জন, ওয়ার্ড বয় ২জন, বাবুর্চি ১জন, সহকারি বাবুর্চি ১ জন, আয়া ১ জন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ৩জন ও সিকিউরিটি গার্ডের ২টি পদ শূণ্য রয়েছে।

গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতালে এম টি ল্যাব, ফার্মাসিষ্ট, প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারি কাম-কম্পিউটার অপারেটর ও ওয়ার্ড বয়ের পদ শূণ্য রয়েছে। ৪টি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ফার্মাসিষ্টের ৪টি পদ ও ১জন অফিস সহায়কের পদ শূণ্য রয়েছে। ৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্রে এস এ সি এম ও এর ৩টি পদ শূণ্য রয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন পর দরিদ্র প্রসূতি মায়েদের জন্য সিজারিয়ান অপারেশন চালু হলেও এ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসকের (অজ্ঞান করার চিকিৎসক) পদ শূণ্য থাকায় গত ৭/৮ মাস থেকে সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ রয়েছে। মাঠপর্যায়ে ৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে তৃণমূলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় ৬ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের বসার ব্যবস্থা না থাকায় তারা সেখানে বসেন না। বছরের পর বছর তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিতে দেখা যায়।

বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে গত মে মাস থেকে ৬জন চিকিৎসককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্তি দেখানো হয়েছে। ৪টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৪জন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের নিয়মিত উপস্থিতি নিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে। দৌলখাঁড় উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দায়িত্বরত চিকিৎসককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সংযুক্তি দেয়া হয়েছে। এতে করে সরকারের তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেবার জন্য চিকিৎসক নিয়োগ দিলেও তারা তৃণমূলে স্বাস্থ্য সেবা না দেয়ায় তৃণমূলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবা থেকে বরাবরই বঞ্চিত রযেছে। অন্যদিকে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে ওষুধ দেয়ার কথা থাকলেও তাদের কোন ওষুধ বরাদ্ধ নেই। যার ফলে রোগীদের কোন ওষুধ দেয়া হয় না।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবদাস দেব বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগে জনবল, অবকাঠামোগত ও যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরী ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ জরুরী হয়ে পড়েছে। । গোহারুয়া ২০ শষ্যা হাসপাতালের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সীমানা প্রাচীর নেই। হাসপাতালটির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, আবাসিক ভবন সংস্কার, আন্তঃবিভাগ ও জরুরী বিভাগ চালুর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন রয়েছে। অন্তত ১৫ টি কমিউনিটি ক্লিনিকের সংস্কার ও মেরামত অথবা পুনঃনির্মাণ জরুরী ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। জোড্ডা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও বক্সগঞ্জ উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবন দু‘টি ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সমস্যার মধ্যেও স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন সমস্যাগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

সংবাদ সারাদিন