চলে গেলেন কামাল লোহানীও

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

কামাল লোহানীও চলে গেলেন। শনিবার সকালে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে তিনি মারা যান। একজন রাজনৈতিক মানুষ, আলোকিত মানুষ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-এসব কিছু ছাঁপিয়ে কামাল লোহানী ছিলেন সাংবাদিক।

সকাল সোয়া ১০টার দিকে চিকিৎসকরা তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কামাল লোহানীর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন।

হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের সমস্যার পাশাপাশি ফুসফুস ও কিডনি জটিলতা নিয়ে গত ১৭ই মে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পরে করোনাভাইরাসেও সংক্রমিত হন। এরপর তাকে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতাল থেকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নেওয়া হয়।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খান ছনতলা গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরে তাকে সমাহিত করা হবে।

একুশে পদকপ্রাপ্ত কামাল লোহানী বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠনের একজন এগিয়ে থাকা মানুষ ছিলেন। সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের বার্তা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক

রাষ্ট্রপতি তার শোক র্বাতায় বলেন, “সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে কামাল লোহানী বিপুল অবদান রেখেছেন।

সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তিনি ছিলেন একজন পুরোধা ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারালো। তার মৃত্যু দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি।”

রাষ্ট্রপতি কামাল লোহানীর বিদেহি আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

বাঙালির ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে কামাল লোহানীর অগ্রণী ভূমিকা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোক বার্তায় বলেন, “আমরা একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধাকে হারালাম।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‍“একজন আদর্শবান ও গুণী মানুষ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা এবং দেশের সংস্কৃতি বিকাশের আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।”

কামাল লোহানীর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনাও জানান প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়াও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।

কামাল লোহানী হয়ে ওঠা

কামাল লোহানীর প্রকৃত নাম আবু নাইম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া গ্রামের খান ছনতলা গ্রামে ১৯৩৪ সালের জন্ম নেন তিনি।

পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫২ সালে তিনি। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার পথে পা বাড়াননি আলোকিত মানুষটি।

পাবনা জেলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাকে কারাগারে যেতে হয়।

মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। সেই সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন।

পরের বছর আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে তার বন্দিজীবন কাটে।

১৯৫৮ সালে কামাল লোহানী যুক্ত হন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

১৯৬২ সালে কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন তার রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে গান গাইতেন আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু দাশ, আবদুল লতিফসহ প্রথিতযশা শিল্পীরা ।

ষাটের দশকের শেষ ভাগে ন্যাপের (ভাসানী) রাজনীতিতে জড়িয়ে কামাল লোহানী যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও কামাল লোহানী সম্পৃক্ত ছিলেন পুরোপুরি।

১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী একজন শিল্পী, একজন সাংবাদিক ও একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন। সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান।

১৯৭৫ এর ১৫ই অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী। ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

সাংবাদিক কামাল লোহানী

কামাল লোহানীর সাংবাদিকতার শুরু হয়েছিল দৈনিক মিল্লাত দিয়ে। এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই দফা যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন স্বাধীনতার ঠিক আগে। সাংবাদিকতার জন্য ২০১৫ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুই বার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন কামাল লোহানী। ছায়ানটের সম্পাদক ছিলেন পাঁচ বছর।

মৃত্যুর আগের বছরগুলোতে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা পদে ছিলেন তিনি।

বিয়ে করেন ১৯৬০ সালে দীপ্তি লোহানীকে। যিনি মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তিন সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে হলেন বন্যা ও ঊর্মি লোহানী, আর ছেলে সাগর লোহানী।

“আলোকিত এই সাংবাদিক, রাজনৈতিক সজ্ঞানী মানুষটির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছে সংবাদ সারাবেলা পরিবার”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন