করোনায় এই মূহুর্তে করনীয় : একটি প্রস্তাবনা

বিপ্লব শাহনেওয়াজ
করোনার চাপে বা শঙ্কার কারনে জরুরী চিকিৎসার অভাবে অথবা অবহেলায় অন্য রোগী মারা যায় – তা অবশ্যই ফৌজদারী অপরাধ। তবে অপরাধী কিন্তু একমাত্র ডাক্তার বা স্বাস্হ্যকর্মী নয়- অপরাধী নীতিনির্ধারক, স্বাস্হ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্হ্যরাজনীতির সঙ্গে জড়িত সবাই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। তবে সেই সঙ্গে আমাদের অব্যবস্থার কথাও তুলে ধরতে চাই।
SARS CoV-2 হচ্ছে নতুন আবিস্কৃত করোনা ভাইরাসটির নাম যা কোভিড-১৯ নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। ভাইরাসটি সাধারন সর্দি-জ্বর থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে সক্ষম। এ পর্যন্ত ২০০ এর অধিক দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থা ইতিমধ্যে প্যানডেমি ঘোষনা করেছে। বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন রকম কর্মপন্থা নিয়েছে। উন্নত দেশগুলিও রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে ভাইরাসটির দ্রুত বিস্তার এবং মৃত্যুহার রোধে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ধ্বস, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ এসবের শঙ্কা তো রয়েছেই।
অদৃশ্য অনুজীবটি আমাদের মানবজাতির স্বাধীনতার সীমারেখা এঁকে দিয়েছে। মানবকোষের ঝিল্লি আজ আমাদের সীমান্ত। এই কোষঝিল্লি দিয়েই ভাইরাসটি মানব শরীরে প্রবেশ করে। আক্রান্ত করে। সেই সীমান্তকে সুরক্ষা করতে আজকের যুদ্ধ।যে যুদ্ধের এক পক্ষে সমগ্র মানবজাতি আর অন্যপক্ষের অদৃশ্য একটি ভাইরাস। আর যুদ্ধে পরাজয় হলে হুমকির মুখে মানবসভ্যতা আর পৃথিবীর বুকে আমাদের অস্তিত্ব। এই যুদ্ধে নিরাকার স্রষ্টার মসজিদ, মন্দির আর উপসনালয়ও জনমানবহীন, নিস্তব্ধ। জনমানবহীন লোকালয়, গঞ্জ, হাট-বাজার। জনমানবহীন মৃত্যুপুরী পৃথিবীর বড় বড় নগর মহানগর। ২৪/৭ আড্ডার কফির কাপগুলো শুকনো পরে আছে। বারের বিয়ারের গ্লাসগুলো শব্দ করছে না। নাইটক্লাবগুলো দিনের নিস্তব্ধতায় দিনের পর দিন পার করছে। মৃত্যুর পরে প্রিয়জনের লাশটি ছোঁয়া তো দূরের কথা দেখা পর্যন্ত যাচ্ছে না।
পৃথিবী আজ এমন এক কঠিন বাস্তবতার মুখামুখি। একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক সময়ে যখন আমরা ২০২০ সালের নববর্ষের জন্য আতশবাজি ফুটিয়েছিলাম- তখনো ভাবতে পারিনি করোনা নামক ভাইরাসটি আমাদের এভাবে নাস্তানাবুদ করবে।
অনুজীবেরা আমাদের তো বটেই অন্যান্য সব জীবের আগে পৃথিবী শাসন করেছে। বিবর্তনের ধারায় ৯৯ ভাগ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এক একটা বিলুপ্তি সুযোগ সৃষ্টি করেছে নতুন সৃষ্টির। মানবজাতি সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকেই মূলত অনুজীবের বিরুদ্ধেই অস্তিত্বের সংগ্রাম করে আসছে। ভবিষ্যতেও করবে। এভাবেই টিকে থাকতে হবে। আর প্রতিবার একটাই প্রশ্নের মুখামুখি হতে হবে – আমরা কতটা অসহায়? কতটা ক্ষুদ্র? কতটা অক্ষম?
ইতিহাসের এই সব সময়ের প্রয়োজনে চিন্তাধারা মূল্যবোধ কত কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তিত পরিবর্ধিত পটভূমিতে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন আজ হাসপাতাল। ফিল্ড হাসপাতাল। লাইন অব ফায়ার ইমারজেন্সি রুম। প্রতিরক্ষা মানে আজ মিসাইল নয়। ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ বিমান বা সাবমেরিন নয়। একটি ছোট বোতলজাত কার্যকর ভ্যাকসিন আজ পারমানবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী।
পিপিই আজ বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের চেয়েও প্রয়োজনীয়। বানিজ্য থেমে গেছে। স্থবির শিল্প কারখানা। কামানের গোলা আজ সাময়িক ভাবে বিকল যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলিতে। টেলিভিশনের লোভনীয় রান্নার অনুষ্ঠান, টকশো আজ আর চিত্তবিনোদন করে না। মনোরঞ্জনের জন্য সব কিছুই আজ পানসে- সবার নজর আজ কোভিড-১৯ দিকে। হাতধোয়ার প্রতিযোগিতায় আমরা সবাই ফুটবল, রাগবি বা ক্রিকেটের বদলে। মেসি রোনাল্ডো নয় আজকের খেলোয়াড় নার্স, ডাক্তার এবং স্বাস্হ্যকর্মী। মদের দোকানের স্প্রিট আজ হাত পরিস্কারের বস্তু। মুখঢাকা মহিলা মানে আজ ধর্মপ্রাণ মুসলিম পর্দানশীন মহিলা নয়;- নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষ। অথচ কিছুদিন আগেও ইউরোপের অনেক দেশে আইন হয়েছে মুখমন্ডল ঢেকে চলাচল করা যাবে না। ট্রেনে বাসে প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গন আজ সামাজিক দূরত্বের কবলে। প্রতিদিন মরছে মানুষ। প্রতিদিন মানুষ মরে। কিন্তু এ যেন এক অন্য মৃত্যু।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি একজন চিকিৎসক। জরুরী চিকিৎসা এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসা ক্ষেত্র আমার বিশেষত এলাকা। জরুরী চিকিৎসার ব্যাপ্তি রোগীর অসুস্থ হবার স্থান থেকে, রোগী পরিবহন, পরিবহনকালীন চিকিৎসা, জরুরী বিভাগ হয়ে প্রয়োজনে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রোগীর চিকিৎসা পর্যন্ত। সাধারন হাড়ভাঙ্গা থেকে শুরু করে এ্যাংজাইটি। স্ট্রোক থেকে শুরু করে ইনফেকশন। সড়ক দূর্ঘটনা। জাতীয় কোন দুর্যোগ, ক্যাটাস্ট্রোফি, ভবনধস, রাসায়নিক বা জৈবিক কনটামিনেসন। এমনকি আজকের এক বৈশ্বিক বিপর্যয় বা প্যানডেমি। আমার কর্মস্থান সুইডেন তথা ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় উপসলার মেডিকেল ইউনিভার্সিটি হসপিটাল। আমার অভিজ্ঞতা, আমার জ্ঞান এবং আবেগের সমন্বয়ে যে মনস্ক তা সূদুর প্রবাসেও জন্মভূমিকে ঘিরে রয় প্রতিটা মূহুর্তেই- চেতনায় এবং অবচেতনায়। আমি জাতীয়তাবাদের ক্ষুদ্রতায় বিশ্বাস করি না। তবুও আমি দেশপ্রেমিক। জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধ। আমি আমার বর্তমান নাগরিক দায়দ্ধতা সম্পর্কে সচেতন। আমি আমার কর্মপরিচয়ে বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র দেশটির বৈশ্বিক পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করি। ‘আমি তারি হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’। আমি পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দা- বিশ্ব নাগরিক হিসাবে ভাবতেই সাচ্ছন্দবোধ করি। যেমনটি একজন চিকিৎসকের কাছে একজন রোগী। কার কোন ধর্ম, বর্ণ বা সামাজিক মর্যাদা আমার কাছে মূখ্য নয়; বিবেচ্য নয়। মানুষ এবং মানুষের সমস্যা আর তাঁর সেবাই মূখ্য। আজকের এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ে চিকিৎসক হিসাবে মাতৃভুমির পাশে দাঁড়াবার যে দায়বদ্ধতা তার থেকেই লিখছি। আমার কাছে আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় যা মনে হয়েছে – যা এই মূহুর্তে বাংলাদেশের করা উচিত তার একটা ধারনা দিচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আমার একজন প্রিয় ব্যাক্তিত্ব, তাঁর সূযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই অনেক কার্যকর ভুমিকা নিয়েছে। তবুও আমার মনে হয় – আমার পরামর্শ বলবো না অভিমত থেকে হয়তো কিছুটা হলেও ধারনা পাবে কি ভাবে পশ্চিমাদেশে জরুরী চিকিৎসার আলোকে এমন একটি বৈশ্বিক বিপর্যয় মোকাবিলা করা হয়।
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জনশক্তি, স্বাস্হ্যসেবা সবকিছু বিবেচ্য রেখে আমার প্রস্তাবনা এবং অভিমতগুলো প্রকাশ করছি। তিনটি পর্যায়ে সংক্রমন নিয়ন্ত্রন, ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসা হিসাবে আমি আলোচনা করছি।
১) ব্যাপক সংক্রমন নিয়ন্ত্রন
২) কোভিড ১৯ প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা এবং
৩) সম্মূখ যুদ্ধে করোনা চিকিৎসায় করনীয়
ব্যাপক সংক্রমন নিয়ন্ত্রন:
ব্যাপক সংক্রমন রোধে প্রথমেই প্রয়োজন তৃনমূল পর্যন্ত ব্যাপক প্রচার যার মূল উদ্দেশ্য জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ে নিজ দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতার উত্তরন।
নিজ দায়িত্বে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বিশেষ করে শরীরের কোন উপসর্গ দেখা দিলে তো অবশ্যই। শরীরের উপসর্গ গোপন করা মানুষ হিসাবে একটা মৌলিক সততার প্রতি অমর্যাদাকর। ভয় না পেয়ে এভাবে নিজেকে সংযত রাখলে মারাত্মক রোগের বিস্তার অনেকটাই সীমিত হবে। রোগীর উপসর্গ যদি এমন হয় যে, রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে হবে – তবে অবশ্যই রোগী স্বাস্হ্যসেবা নেবে কিন্তু অন্যকে সংক্রমন এড়িয়ে সঠিক পথে।
করোনার জীবানু নাক, মুখ এবং চোখের শ্লেষ্মা বা মিউকাস থেকে শরীরে ঢোকে। ত্বক থেকে নয়। আর আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি হাঁচি-কাশী, কফে এবং শরীর নিসৃত রসে জীবানু থাকে। তাই হাতের মাধ্যমে যাতে রোগটির বিস্তার না ঘটে তার জন্য হাত মুখমন্ডলে আনা যাবে না। কি ভাবে জীবানুমুক্ত থাকতে হাত ধুতে হয, হাঁচি-কাশি দিতে হয় তা শিখতে হবে। কারো হাঁচি-কাশি থাকলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এমনকি বাসায় বসে যদি করোনা সন্দেহের রোগীর সেবা করা হয় তবে সেবাদানকারী অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন।
মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন তথ্য প্রচলিত আছে। ড্রপলেট ছাড়াও এরোসল মাধ্যমে জীবানুটি ছড়ায় বলা হচ্ছে- সেক্ষেত্রে সবাই বিশেষ করে বাইরে চলাচলের সময় সঠিক মাস্ক (যা ওয়াটারপ্রুফ) ব্যবহার করতে পারে। একটি মাস্ক অনেক সময় ধরে ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। কতক্ষন একটা মাস্ক ব্যবহার করা যায় তা নির্ভর করে কি ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। মাস্ক ব্যবহারের পরে, এমনকি পেশাদার স্বাস্হ্যকর্মীদের PPE ব্যবহারের পরে সঠিক ভাবে ডিসপোজাল অনেক বেশী জরুরী। তা না হলে জীবানুর বিস্তার রোধ অসম্ভব।
কোভিড ১৯ মোকাবিলায় জন্য একটি জাতীয় ওয়েবসাইট তৈরী করা প্রয়োজন; বিশেষ করে দ্বিমূখী তথ্য এবং বিভ্রান্তি রোধের জন্য। যেই ওয়েবসাইটে চিকিৎসা সেবার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যে যেমন নির্দেশনা থাকবে; তেমনি তথ্য, খবর এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা থাকবে স্পষ্টভাবে সাধারন মানুষের জন্য। তথ্য বিভ্রান্তি রোধে জাতীয় ওয়েবসাইট খুবই জরুরী।
কোভিড ১৯ পজিটিভ বা সন্দেহযোগ্য রোগীদের যদি বাড়িতে সামাজিক দূরত্বে আইসোলেসনে রাখা না যায় – সে ক্ষেত্রে হোটেলরুম, স্কুল বা সেই রকম উপযুক্ত এলাকাকে দুর্যোগপূর্ন সময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোভিড ১৯ প্যানডেমিক নিয়ন্ত্রনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা:
কোভিড ১৯ নামে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে রোগ নিয়ন্ত্রন এবং চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার মধ্যে সমন্নয় সাধন, সমন্বিত কার্যক্রম, ব্যবস্থাপনা এবং যোগাযোগ ও তথ্য আদান প্রদান নিশ্চিন্ত করা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উচিত জনসম্মূখে এই তথ্য নিয়ে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করা যে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কত মানুষ আক্রান্ত হবার আশঙ্কা আছে। কত মানুষের উচ্চতর চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে এবং আমাদের কি পরিমান সেই চিকিৎসা দেবার সক্ষমতা আছে এবং সর্বশেষে কত সংখ্যক মানুষ মারা যেতে পারে।
এসব সত্য ভাষনের দুইটি উপকারিতা আছে জনগন মহামারীর বিস্তৃতি এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পাবে। আতঙ্কিত না করে রোগের সংক্রামন রোধে সাবধানতার পথে নেয়া সহজ হবে। এবং সর্বোপরি মহামারী শেষে সরকার যদি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেয়া রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কিত ভবিষ্যতবানীর চেয়ে কম ক্ষতি করে রোগের নিয়ন্ত্রন করতে পারে – তা অবশ্যই হবে একটি সফলতা। এমনকি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোন থেকে হতে পারে একটি উদাহরণের দৃষ্টান্ত।
করোনা রোগীদের বিশেষ চিকিৎসার জন্য প্রতি বিভাগে একটি করে অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল তৈরী করতে হবে – যা নির্মান এবং নিয়ন্ত্রনের ভার সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া যেতে পারে অন্য দেশগুলির মতো করে। হাসপাতালগুলি কোভিড ১৯ আইসিইউ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেখানে থাকবে একটি কোভিড- জরুরী বিভাগ।
টিমওয়ার্ক এই মূহুর্তে সবচে বেশী জরুরী; বিশেষ করে স্বাস্হ্যকর্মীদের মধ্যে। টিমওয়ার্ক ছাড়া এই যুদ্ধে হতাহতের পরিমান হবে অপূরনীয়। জরুরী ভিত্তিতে এবং ব্যাসিক ট্রেনিং এর মাধ্যমে প্রয়োজন বিশাল পরিমান ভলেনটিয়ার স্বাস্হ্যকর্মী যা নিয়মিত স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তা করবে প্রতিনিয়ত। দুর্যোগ প্রতিরোধের এই যুদ্ধে প্রতিটি স্বাস্হ্যকর্মীর ভুমিকার মর্যাদা এবং স্মীকৃতি অনুপ্রেরনাদায়ক এবং আবশ্যক। জীবন বাঁচাতে নিজের জীবনের বিপদের শঙ্কাকে উপেক্ষা করে যারা মানবসেবায় আত্মনিবেদন করে সেই সব চিকিৎসক, সেবিকা, সেবার সাথে নিয়োজিত অন্যান্য স্বাস্হ্যসেবাকর্মী, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নকারীকর্মী সহ সবাই সমান ভাবে সেই মহাযজ্ঞের সহযোদ্ধা।
সম্মূখ যুদ্ধে করোনা চিকিৎসায় করনীয়:
আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠি, আর্থ-সামাজিক সীমাবদ্ধতা, সীমিত জনবল এবং রিসোর্স দিয়ে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা যেখানে কষ্টকর এবং চ্যালেঞ্জের সেখানে একটি মহামারী সীমাবদ্ধতার সীমারেখা আরো সঙ্কুচিত করে দেয় নিশ্চিত ভাবেই। ইমারজেন্সি মেডিসিন এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ারের কনসেপ্ট এবং অবকাঠামো অনেক উন্নত দেশেই এখনো গড়ে ওঠেনি। আধুনিক Triage সিস্টেম, জরুরী চিকিৎসা বিভাগের অবকাঠামো, emergency room, isolating room, decontamination room, pre-hospital care, pre-hospital management, pre-hospital treatment এবং pre-hospital transport, ক্যাটাষ্ট্রফিক প্লান এসব কিছুই জরুরী চিকিৎসার মৌলিক উপাদান।
স্বাভাবিক ভাবে আমাদের স্বাস্হ্যব্যবস্থার অবকাঠামো এ ভাবে তৈরী নয়। বর্তমান অবকাঠামোর ক্ষতিকর ব্যাপারটি হচ্ছে চরম সংক্রামক কোন রোগী যদি এই ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে তবে স্বাস্হ্যকর্মী থেকে অন্যান্য রোগীরা যেমন সহজে সংক্রামিত হবে তেমনি স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রমের ব্যাত্যয় ঘটাবে নিস্বন্দেহেই। আজ হচ্ছেটাও তাই। সাধারন মানুষদের অভিযোগ চেম্বারে, হাসপাতালে বা ক্লিনিকে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে না। মানুষ অন্য রোগের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে না। ব্যাপকতর ভাবে পিপিই এর ঘাটতি এখন বিশ্বজুড়ে। এ অবস্থায় পিপিই -র অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার সীমিত করা প্রয়োজন করোনা নিয়ন্ত্রনের জন্যই। এই প্রেক্ষাপটে জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে করোনা রোগীর সেবা দেবার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন outsides Triage. যেখানে সবাই পিপিই পরিহিত স্বাস্হ্যকর্মী থাকবে এবং কোভিড রোগীদের প্রাথমিক বাছাই সম্পন্ন করে ভিন্ন করে দিবে। এসব বাছাই কার্যক্রমের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত অনেক পদ্ধতি আছে। প্রাথমিক বাছাইয়ের পরে – দ্বিতীয় স্তরের বাছাই এ করোনা সন্দেহ রোগীর টেষ্ট নেয়া এবং বিচার করতে হবে যে রোগী বাড়িতে বা অন্য কোন আইসোলেসন কক্ষে চিকিৎসা নেবে না তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে বা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার জন্য আইসিইউ তে রাখতে হবে। এই পদ্ধতিতে আমরা কোভিড রোগীদের সংক্রমন থেকে অন্য রোগীদের অনেকাংশেই রক্ষা করতে পারবো।
করোনা সন্দেহে যে রোগী উপসর্গ নিয়ে আসবে এই পর্যায়ে প্রাথমিক বিবেচনার পর সবার টেষ্ট নেয়া নিশ্চিন্ত করা প্রয়োজন। ব্যাপক টেষ্ট এবং টেষ্ট পরবর্তি আইসোলেসন এবং ট্রাকিং না করা হলে এ পর্যায়ে সংক্রমন রোধ সম্ভব নয়। টেষ্ট নেবার স্থান রোগ নিয়ন্ত্রনের স্বার্থেই বিকেন্দ্রীকরন করা প্রয়োজন।
এই মহামারীকালিন অবস্থায় অন্য রোগীরা যাতে তাদের অন্ততপক্ষে জরুরী চিকিৎসা পায় সে ক্ষেত্রে বিপর্যয়কালীন বিকল্প ব্যবস্থা যা সহজলভ্য তৈরী করতে হবে। সাধারন রোগে মৃত্যু রোধ করা দুর্যোগকালীন সবচে বড় চ্যালেঞ্জ। এরজন্য স্ট্রোক, হার্ট এ্যাটাক, অন্যান্য জরুরী হৃদরোগ, ট্রমা, অন্যান্য ইনফেকশন, জরুরী কিডনী চিকিৎসা, জরুরী সার্জারী, জরুরী মাতৃ-প্রসুতি এবং শিশু চিকিৎসার জন্য বিশেষ Triage এবং বিশেষ flowchart তৈরী করা জরুরী। তৈরী করা উচিত বিশেষ গাইডলাইন, হেল্পলাইন এবং অনকল সিষ্টেম।
Pre-hospital কর্মশক্তি তৈরী করা প্রয়োজন যারা এই দুর্যোগের সময় প্রাথমিক চিকিৎসা এবং পরিবহনের সময় সঠিকভাবে সংক্রমন এড়িয়ে রোগীকে সঠিক স্বাস্হ্যসেবার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে পারে। এই পদ্ধতি সঠিক ভাবে না করলে রোগী পরিবহন কালেই অসংখ্য মানুষ সংক্রামিত হবে এবং করোনা অনিয়ন্ত্রিত পথে চলে যাবে।
বিপ্লব শাহনেওয়াজ, সু্ইডেনের উপসলার মেডিকেল ইউনিভার্সিটি হসপিটালে কর্মরত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন