একাত্তরের আজকের দিনে একটি গ্রামকে পুরুষশূণ্য করে পাক সেনারা

যাতে করে কেউ পালাতে না পারে সে জন্যে সৈন্যরা ঘিরে রাখে সোহাগপুর প্রফুল্লের দীঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত গোটা এলাকা। প্রথমেই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন রমেন রাসেল, চটপাথাং ও মিরিশ গ্যাব্রিল নামের ৩ জন গারো অধিবাসী। চটপাথাং ও মিরিশ বাড়ির সামনের মাঠে কাজ করছিল।

|| সারাবেলা প্রতিনিধি, শেরপুর ||

সীমান্ত ঘেঁষা শান্ত গ্রাম দুটির মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতেই বসবাস করে আসছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের কিছু কিছু খবর তারা পাচ্ছিল। বাড়ছিল উৎকন্ঠা আর ভয়।

আর দশটা দিনের মতোই ১৯৭১ সালের ২৫শে জুলাই সকালে সোহাগপুর ও বেনুপাড়া গ্রামের মানুষ কেউ লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে মাঠে গিয়েছিল, কেউ কেউ ছিল বাড়িতেই।

এমন সময় সকাল ৭টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেশিনগানের শব্দে কেঁপে ওঠে উত্তর সোহাগপুর এলাকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষজন আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। নেমে এল এক বিভীষিকা।

নালিতাবাড়ী ও শেরপুর এলাকার আলবদর, রাজাকার ও আলশামসের প্রধান, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও নির্দেশে স্থানীয় আলবদর, রাজাকার, আলশামসের নেতা বল্লু বকা বুড়া, নসা ও কাদির ডাক্তার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় দেড়শ’ সৈন্য নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর ও বেনুপাড়া গ্রামে ঢুকে পড়ে।

যাতে করে কেউ পালাতে না পারে সে জন্যে সৈন্যরা ঘিরে রাখে সোহাগপুর প্রফুল্লের দীঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত গোটা এলাকা। প্রথমেই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন রমেন রাসেল, চটপাথাং ও মিরিশ গ্যাব্রিল নামের ৩ জন গারো অধিবাসী। চটপাথাং ও মিরিশ বাড়ির সামনের মাঠে কাজ করছিল।

দুটি গ্রামে সেদিন মন্তাজ আলী, শহীদ আলী, আবুল বাশার ও হাসেম আলী, সফিউদ্দিন, কিতাব আলী, মোন্নাস আলী, মোহাম্মদ আলী, মমিন মিয়া, কুটুমউদ্দিন, রেজত আলী, ঈমান আলী, ঈমান আলীসহ ২৪৫ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানিদের বর্বর নির্যাতন আর লালসার শিকার হন বিভিন্ন বয়সের ১৭০ জন নারী।

গোটা সোহাগপুরকে ঘিরে চলেছিল নির্মম হত্যার মহোৎসব। প্রায় আটঘন্টা ধরে চালানো পৈশাচিকতায় হত্যা করা হয় ১৮৭ জন নিরীহ মানুষকে। বিধবা হন গ্রামের ৬২ জন নারী। মুহূর্তেই ভেঙে যায় তাদের সাজানো গোছানো সোনার সংসার। সেদিনের হত্যাযজ্ঞ এ গ্রামে তৈরি করল ৫৯টি গণকবর।

স্বাধীনতার পর প্রায় পুরুষহীন গ্রামটি প্রথমে বিধবাপাড়া ও পরে সোহাগপুর বিধবাপল্লী হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার পর ঐ গ্রামের অসহায় বিধবাদের জীবন সংগ্রামে পায় নতুন মাত্রা। যে মাত্রা আরো কষ্টের আর দু:খের। ৭২ পরবর্তী সরকারগুলো তাদের তেমন কোন খোঁজ খবর রাখেনি। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠা এবং কিছু ব্যক্তি নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে এই গ্রামের বিধবাদের সহযোগিতা করেন।

ইতোমধ্যে ২৯জন বিধবাকে রাষ্ট্রিয় অর্থে গড়ে দেওয়া হয়েছে একটি করে পাকাবাড়ি। শহীদদের স্মরণে কাঁকরকান্দিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ চলছে।

প্রথম পর্যায়ে ৮ জন ও পরে ৪ জন, মোট ১২ জন বীরঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র। এরা হলেন: সালমা বেওয়া, হাফিজা বেওয়া, জবেদা বেওয়া, আছিরন বেওয়া, জোবেদা বেওয়া, হাসেন বানু, মহিরন বেওয়া, আছিরন নেছা, জরিতন বেওয়া, হাসনে আরা, হাজেরা বেগম-১, হাজেরা বেগম-২,

সোহাগপুর বিধবাপল্লীকে ‘বীরকন্যাপল্লী’ নামে অভিহিত করেছে রাষ্ট্র।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন