একটি সেতু একটি জনগোষ্ঠি আর বদলে যাওয়ার গল্প

গ্রামবাসীকে নৌকায় করে নাঙ্গলকোট ও চৌদ্দগ্রামে যেতে হতো। গ্রামটির নাঙ্গলকোট অংশে এল জি ই ডি’র অধীনে একটি সেতু নির্মাণ তাদের জীবনধারা বদলে দিয়েছে। নৌকায় করে তাদেরকে আর পারাপার হতে হয় না।

|| বশির আহমেদ, নাঙ্গলকোট (কুমিল্লা) থেকে ||

চাঁন্দেরবাগ। একটি গ্রাম। একটি জনগোষ্ঠি। হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে একাকার আবাসন। নাঙ্গলকোটের একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম হিসেবে এক সময়ে সবার কাছে পরিচিত ছিল। নাঙ্গলকোট এবং চৌদ্দগ্রামের ডাকাতিয়া ও শাখা খাল গ্রামবাসীকে বিচ্ছিন্ন করায় একটি দ্বীপের মধ্যে তাদের বসবাস ছিল। গ্রামবাসীকে নৌকায় করে নাঙ্গলকোট ও চৌদ্দগ্রামে যেতে হতো। গ্রামটির নাঙ্গলকোট অংশে এল জি ই ডি’র অধীনে একটি সেতু নির্মাণ তাদের জীবনধারা বদলে দিয়েছে। নৌকায় করে তাদেরকে আর পারাপার হতে হয় না।

স্বাধীনতার ৪৯ বছরে সেতু নির্মাণে চাঁন্দেরবাগ গ্রামবাসীর স্বপ্ন পূরণে তাদের মধ্যে খুশির ঝিলিক দেখা দিয়েছে। ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে নাঙ্গলকোট এবং চৌদ্দগ্রামের উৎসুক জনতা সেতুটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমাতে দেখা যায়। শিগগিরই সেতুটি খুলে দেয়া হবে সাধারণের জন্য। এসব তথ্য জানিয়েছেন, এল জি ই ডি‘র নাঙ্গলকোট উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ-আল মামুন জানান।

নাঙ্গলকোটের রায়কোট উত্তর ইউনিয়নের চাঁন্দেরবাগ গ্রাম ডাকাতিয়া নদী ও শাখা খাল ঘেরা হওয়ায় উপজেলার একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম ছিল। গ্রামবাসীকে ডাকাতিয়া নদীতে নৌকা করে কষ্ট স্বীকার করে স্থানীয় বাজারে যাওয়া, চিকৎসক দেখানো, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ও অফিসিয়াল কাজে নাঙ্গলকোটে আসতে হতো। দীর্ঘ ৪৯ বছর পর সেতু নির্মাণ হওয়ায় নৌকায় করে তাদের আর যাতায়াত করতে হবে না।

গ্রামটি এক সময় হিন্দু অধ্যুষিত হলেও বর্তমানে অনেকগুলো মুসলমান পরিবারও এখানে থাকছেন মিলেমিশে। অনেক হিন্দু পরিবার সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে চলে গেছে। বর্তমানে ৩৭টি হিন্দু এবং ১৮টি মুসলমান পরিবার বসবাস করে এই গ্রামে। মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪শ’ জন। হিন্দু পরিবারগুলো ডাকাতিয়া নদীতে মাছ ধরে এবং মাছের রেণু পোনা বিক্রি করে খেয়ে-না খেয়ে জীবিকা বয়ে নেন। মুসলমান পরিবারগুলো ছোট খাটো ব্যবসা বাণিজ্য এবং অনেক পরিবারের সন্তানেরা প্রবাসে থেকে আয় করছেন।

এল জি ই ডি সূত্রে জানা যায়, নাঙ্গলকোট উপজেলা স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এল জি ই ডি) অধীনে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে শান্তিরবাজার-পিপড্ডা পল্লী সড়কে ডাকাতিয়া নদীর উপর ৩ হাজার ২শ ৭০ মিটার চেইনেজে ৮১ মিটার দীর্ঘ গার্ডার সেতুটি নির্মাণে ৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার ৪৭ টাকা ব্যয় হয়।

সম্প্রতি চাঁন্দেরবাগ গ্রাম ও সেতু এলাকা ঘুরে এলাকাবাসীর সাথে কথা হয়। চাঁন্দেরবাগ গ্রামের বয়োবৃদ্ধ মলিন চন্দ্র দাস, যোগেশ চন্দ্র দাস, রাখাল চন্দ্র দাস, স্কুল শিক্ষার্থী ঈশান চন্দ্র দাস, প্রশান্ত চন্দ্র দাস জানান, আমাদেরকে দীর্ঘদিন থেকে নৌকা দিয়ে কষ্ট করে নাঙ্গলকোট উপজেলা সদর এবং বিভিন্নস্থানে যাতায়াতসহ বিদ্যালয়ে যেতে হতো। সেতুটি নির্মাণ হওয়ায় আমাদের সহজ যাতায়াতের সুযোগ সুষ্টি হয়েছে। এতে আমরা অনেক খুশি।

সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন না হলেও প্রতিদিন সকাল-বিকেল সেতুটির সৌন্দর্য দেখতে নাঙ্গলকোট এবং চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কিশোর এবং তরুণ-তরুণীদের ভিড় দেখা যায়। চৌদ্দগ্রামের দেড়কোটা ও তারাশাইল গ্রামের ইশতিয়াক, আবদুল্লা, আরমান রাজ, রায়হান, সাগর, নেহাল মোটরসাইকেল নিয়ে বিকেলে সেতুটি দেখতে আসেন।

তারা বলেন, সেতুটি দু‘উপজেলার মানুষের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করেছে। নাঙ্গলকোটের পিপড্ডা গ্রামের নুরুল ইসলাম সেতুর এক পাশে বিভিন্ন খাবার ও পানীয় বিক্রির দোকান দিয়ে বসেছেন। তিনি জানান, প্রথমদিকে কম বিক্রি হলেও মানুষের উপস্থিতি বাড়ার সাথে-সাথে বিক্রিও বাড়বে বলে তিনি আশা করেন।

নাঙ্গলকোট উপজেলা প্রকৌশলী আবদুল্লাহ-আল মামুন বলেন, ডাকাতিয়া নদীর উপর সেতু না থাকায় চাঁন্দেরবাগ এলাকাটি উপজেলার ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সেতুটি নির্মাণের ফলে এলাকার জনসাধারণের ব্যবসা-বাণিজ্য, স্কুল-কলেজে যাতায়াতসহ জীবনযাত্রার মান ব্যাপক উন্নত হবে। সেতুটি শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে।

প্রকৌশলী আবদুল্লাহ-আল মামুন আরো বলেন, তাদের চলাচলের কাঁচা রাস্তাটিও পাকা করা হবে।

সংবাদ সারাদিন