শাস্তির অপেক্ষা উচ্চ আদালতে
|| সারাবেলা প্রতিনিধি, ফেনী ||
ফেনীর সোনাগাজীর সেই আলোচিত মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যার দুই বছর হয়ে গেলো। আজ থেকে দুই বছর আগে ২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে প্রকাশিত নৃশংস এই খুনের সংবাদে স্তম্ভিত হয়েছিলে বিশ্ববাসী। ক্ষুব্ধ হয়েছিল ফেনীসহ গোটা দেশের মানুষ।
নুসরাতকে ২০১৯ সালের ২৭শে মার্চ নিজের অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করেন তারই শিক্ষক সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। এর প্রতিকার চেয়ে সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেছিলেন নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার। ওইদিনই স্থানীয়দের সহায়তায় অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য ও মামলা তুলে নিতে তার অনুগতরা নুসরাত ও তার পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। ৬ই এপ্রিল পরীক্ষা দিতে গেলে সিরাজের লোকজন নুসরাতকে মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে ডেকে নেয়। মামলা তুলে নিতে চাপ দিলে সে অস্বীকার করে। এসময় হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসীরা সটকে পড়ে। আগুনে দগ্ধ নুসরাতের আর্ত চিৎকারে অনেকেই এগিয়ে আসে। নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্থর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
বর্বরোচিত এ ঘটনায় দেশ-বিদেশে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। এ হত্যাকান্ডকে শুরু থেকেই আত্মহত্যা বলে চালাতে চেষ্টার কসুর করেননি থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। গণমাধ্যমের দৃঢ় অবস্থান এবং পিবিআইয়ের তদন্তে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতে থাকে।
এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ই এপ্রিল হত্যা মামলা করেন। এই মামলায় ২০২০ সালের ২৮শে মে অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০শে জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে ৩০শে সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪শে অক্টোবর দিন নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক নেয়া হয়। একই বছরের ২৪শে অক্টোবর মামলার অভিযোগপত্রে অর্ন্তভূক্ত ১৬ আসামীর সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে একলাখ টাকা করে অর্থদন্ড করেন।
দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মাদ্রাসা গভর্নিং কমিটির তৎকালীন সহ-সভাপতি রুহুল আমিন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম (৫০), নুর উদ্দিন (২৩), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), প্রভাষক আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
২৯শে অক্টোবর আসামীদের মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডাদেশ হলে অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিলো। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়েছিল। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য দিনও নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বাদী পক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানিও হয়। এরপর আর গেলো দুই বছরে আগায়নি কিছুই।
নিহতের বাড়ীতে শোকমাহফিল
নুসরাতের আত্মার মাগফেরাত চেলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সীমিত পরিসরে কোরআন খতম, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১০ই এপ্রিল ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত। মৃত্যুশয্যায় থেকেও খুনীদের বিচার চেয়েছিলেন নুসরাত। বিচারও হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৪শে অক্টোবর ১৬ আসামীর মৃত্যুদন্ডের আদেশও দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত। আসামীদের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আপীলও করা হয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মহামারীর অজুহাতে আটকে আছে আপীলের শুনানী। এদিকে উচ্চ আদালতেও ফাঁসির আদেশ বহাল চেয়ে আসামীদের নির্ধারিত শাস্তি কার্যকরের অপেক্ষায় তার পরিবার।
বর্তমানে পুলিশি পাহারায় রয়েছে নুসরাতের বাড়ি। তার মা শিরিনা আক্তারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আজকে দুটি বছর নির্ঘুম রাত পার করছি। মেয়ের শোবার ঘরেই আমি ঘুমাই। মেয়ের মৃত্যু যন্ত্রণার সেই চারটি দিন ছিল আমার কাছে বিভীষিকার। সেই ভয়াল দিনগুলো আমার চোখে ভেসে আসলে আর ঘুমাতে পারিনা। এর মাঝে আমার একটি ছেলেকেও বিয়ে করিয়েছি। আজকে আমার মেয়ে বেঁচে থাকলে আরেকজনের গৃহবধূ হতো। কিন্তু নুসরাতের শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। আমার পরিবারের সদস্যদের সেই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুকে টেনে ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। আমি শতভাগ আশাবাদী উচ্চ আদালতেও আসামীদের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকবে। আমরা আসামীদের ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় আছি। উচ্চ আদালতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পাবে।