অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারে চলছে দেবিদ্বার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। নানা অনিয়ম ও সমস্যার মধ্য দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে হাসপাতালটি।

|| মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, কুমিল্লা ||

অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। নানা অনিয়ম ও সমস্যার মধ্য দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে হাসপাতালটি। হাসপাতালটির প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। চিকিৎসা সেবার নামে সরকারি হাসপাতালটিতে চিকিৎসকদের ফাঁকিবাজি, রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত না করে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সময় দেয়া, বয়স্ক ও গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা নিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে মাসোহারা নিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাধ্য করা, ভর্তি রোগীদের অস্বাস্থ্য খাবার পরিবেশন, রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না করা, নার্সদের ডিউটিতে অবহেলা, চিকিৎসকরা নিয়ম মাফিক ডিউটি না করাসহ নানা অনিয়ম রয়েছে হাসপাতালটিতে। অফিস সময়েও এখানকার একাধিক চিকিৎসক বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মোটা অংকের ভিজিট নিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে৷

দেবিদ্বার উপজেলার ৪ লাখ ২৮ হাজার জনসংখ্যার একমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে উপজেলার ৫০শয্যা হাসপাতালটিই ভরসা। জেলা শহরের অদূরে অবস্থিত উপজেলাটিতে বসবাসরত বাসিন্দারা চিকিৎসা সেবা নিতে ছুটে আসেন হাসপাতালটিতে। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে রোগীরা নানা রকম ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

চিকিৎসকদের স্বেচ্ছাচারিতা ও চিকিৎসাসেবার নামে পুরো স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স জুড়ে রয়েছে অনিয়ম। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে এই এলাকার নিরীহ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা। স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কমর্রত চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালিপনায় ব্যাহত হচ্ছে উপজেলাবাসীর স্বাস্থ্যসেবা। কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকট বিদ্যমান থাকাবস্থায় সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম গিলে খাচ্ছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে।

গত রোববার ২০শে ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আহাম্মদ কবীরের কক্ষের সামনে সেবা নিতে আসা রোগীদের লম্বা লাইন। ডাক্তারের অপেক্ষায় সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে এসব রোগীরা। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললেও দেখা মেলে না হাসপাতালটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ এমন অনেক চিকিৎসকের।

মহিলা রোগী দেখার কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, তিনজনের ডিউটি থাকার কথা থাকলেও ডা. শামসুর নাহার নামে একজন চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। তিনজনের স্থলে একজন চিকিৎসক হওয়ায় কক্ষের বাইরে মহিলা রোগীর দীর্ঘ লাইন। এর মধ্যে রয়েছে ষাটোর্ধ্ব একাধিক মহিলা, রয়েছেন গর্ভবতী নারীরাও। একে তো ডাক্তারের অপেক্ষা তার চেয়ে বেশি ভোগান্তি সৃষ্টি করছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক এবং ফার্মেসির প্রতিনিধিরা। ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হলেই রোগীদের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে টানাটানি করতে দেখা যায় তাদের। মহিলা রোগী দেখার কক্ষে দেখা যায় কয়েকজন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ডাক্তারের সাথে বেশ সখ্যতার সাথে বসে বসে কথা বলছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বক্তব্য দেননি কর্তব্যরত ডাক্তার।

চিকিৎসা নিতে আসা কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে ভিতরে ও বাইরে দিনভর বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড় লেগেই থাকে। হাসপাতালের চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা রোগীদের হাত থেকে চিকিৎসাপত্র ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের কোম্পানির ওষুধের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে দেখা যায়।

এই হাসপাতালের কিছু অসাধু চিকিৎসক মাসোহারা নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধের নাম চিকিৎসাপত্রে দীর্ঘদিন ধরে লিখে আসছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। এছাড়াও এক্স-রে, ইসিজি পরীক্ষাগার কক্ষে গিয়ে দেখা যায় তালা ঝুলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মচারী জানান, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক থেকে ডাক্তাররা ৪০ শতাংশ কমিশন নিয়ে রোগীদের হাসপাতালের বাইরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পাঠান। এই বিষয় ডাক্তারের এক সহকারি ও স্থানীয় কিছু তরুণ রোগী দেখার সাথে সাথে রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিকের কার্ড ধরিয়ে দেন। সরকারি পরীক্ষাগার গুলো বন্ধ বলে বুঝিয়ে প্রতিনিধিদের মধ্যমে রোগীদের বেসরকারি ক্লিনিক গুলোতে পাঠিয়ে কমিশন আদায় করেন।

উপজেলার বড় আলমপুর থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা শিরিনা বেগম জানান, তিনি সকাল ৮ টায় টিকেট কেটে বসে আছেন, সকাল পেরিয়ে দুপুর হলেও ডাক্তারের দেখা মিলেনি। এসময় ওই ডাক্তারের কক্ষে কয়েকজন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা

এ প্রতিবেদককে কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলেন, ডাক্তার সাহেব বাসায় আছেন, কিছুক্ষণ পরে আসবেন। তাই আমরা বসে আছি। এদিকে ডাক্তারের সহকারী বললেন ভিন্ন কথা, বলেন স্যার তো মিটিংয়ে আছেন। কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক চিকিৎসা দিলেও বেশীর ভাগ ডাক্তারই তাদের কক্ষে নেই।

উপজেলার জাফরগঞ্জ থেকে আসা রানুয়ারা নামের আরেক রোগী বলেন, চারদিন হলো হাসপাতালে ভর্তি হলাম। হাসপাতালে খাবারের মান খুবই নোংরা, মাঝে মাঝে রাতে বাসি খাবার দেয়া হয়। রোগীরা এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করলেও মিলে না কোনো সমাধান মিলেনি। সঠিক সময়ে নার্স ও চিকিৎসদের উপস্থিতি পাওয়া যায় না।

অপরদিকে সরকারি ওষুধও নিয়মিত পাওয়া যায় না এই হাসপাতালে। দুই একটা ওষুধ ছাড়া বাকি সব ওষুধই বাহিরের দোকানগুলো থেকে কিনে আনতে হয়। রাতের বেলা নার্সদের সেবা চাইলে আলদা বোনাস দিতে হয়। হাসপাতাটিতে ২২জন নার্স থাকলেও ডিউটি অনুসারে হাজিরা খাতায় দেখানো হয় ৪ জনকে। কিন্তু পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় একজন নার্স ঘুরে ঘুরে সেবা দিচ্ছেন। বাকিদের বিষয় জানতে চাইলে ওই নার্স বলেন- বড় স্যারের সাথে কথা বলেন।

অভিযোগের বিষয়ে ডা. আহাম্মদ কবীর বলেন, আসলে আমি উপজেলা প্রশাসনের মিটিং থাকায় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম না। তবে রিপ্রেজেনটেটিভ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক এবং ফার্মেসি প্রতিনিধিদের অন্য হাসপাতালের তুলনায় এখানে ভিড় ও রোগীদের বিড়ম্বনার বিষয়টি সত্য। কয়েকদিন আগেই আমরা ৩ জন দালালকে আটক করে প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়েছে। আমাদের এখানে কোনো নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় রোগীদের ভিড়ে দালাল চক্রটিকে চিহ্নিত করা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর।

ডাক্তার উপস্থিতি না থাকায় বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই নিয় ডাক্তারদের নোটিশ করা হচ্ছে। এক্স-রে, ইসিজি পরীক্ষাগার চালু রয়েছে, হয়তো সেদিন ওনারা ছুটি ছিলেন বলে তিনি দায়সারাভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন।

এ বিষয় জানতে চাইলে কুমিল্লা সিভিল সার্জন ডাক্তার নিয়াতুজ্জামান বলেন, বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাকে জানানো হয়েছে।এ সব সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া উপজেলা কমপ্লেক্সের সেবার মান বাড়াতে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ আমরা হাতে নিয়েছি।

সংবাদ সারাদিন