পাল্টে যাওয়া জলবায়ু ও তার অভিঘাত বিস্তৃতি

|| শেখ আনোয়ার ||

বিশ্বজুড়েই চলছে প্রকৃতির সঙ্গে যান্ত্রিক সভ্যতার ধারকদের শত্রুতা। সেই শত্রুতার জেরে প্রকৃতি যাচ্ছে বিগড়ে। বিশেষ করে এই শত্রুতার প্রকাশটা সবথেকে বেশী ঘটছে জলবায়ু তথা আবহাওয়ার বৈরি আচরণের মধ্য দিয়ে। কথা হচ্ছে আবহাওয়া কী ইচ্ছে করে এমন বৈরি আচরণ করছে তার স্বজন মানুষের সঙ্গে। না– আমরা বিশেষ করে যান্ত্রিক সভ্যতার ধারকেরা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকান্ডের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়াতেই এমনটা ঘটছে। 

বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রের মত বাংলাদেশও প্রকৃতির অনিচ্ছাকৃত এই আচরণের শিকার। হরহামেশা দেখা যাচ্ছে, এখানে বৃষ্টি আছে তো ওখানে নেই। বর্ষার সময় বর্ষার দেখা মেলে না। সব জায়গায় মৌসুমি বর্ষা ঠিকমতো বর্ষণ করে না। অনেকটা সময়জুড়ে অনাবৃষ্টি থাকছে। দীর্ঘ দিনের অনাবৃষ্টি মারাত্মক ক্ষতি করছে চাষের। পরে কম সময়ের ব্যবধানে হতে দেখা যায় ওই বকেয়া বৃষ্টি। দেখা যায়, শীতকাল তবু বৃষ্টি। ঠা ঠা পড়া রোদে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি। অহরহ বজ্রপাত, বছরে কয়েকবার বন্যা, টর্নেডো, ঝড়ঝঞ্ঝা ও সাইক্লোনের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

আবহাওয়ার এমন আচরণে বাংলাদেশের শ্যামল, সবুজ-সুন্দর স্বাভাবিক পরিবেশ প্রতিবেশ আর আগের মতো চোখে পড়ে না। যেনো বদলে গেছে অনেকখানি। অসময়ে চরম তাপমাত্রা, গরমে হাঁসফাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বায়ুপ্রবাহের বেপরোয়া চলাফেরা, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বাড়তে থাকা। এমনিসব পাল্টে যাওয়ার খেসারত মানুষকে এখন হাড়ে হাড়ে দিতে হচ্ছে।

প্রকৃতির বৈরিতার কারণে শুধু মানুষ নয়, গোটা প্রাণীকূলের যাপিতজীবনই আজ বিপর্যস্ত। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের আশঙ্কা, ‘আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ ভাগ সমতল তলিয়ে যেতে পারে সাগরের অতল তলে।’

তাপমাত্রার বৈরিতায় দাবানলে পুড়ে যাওয়া অ্যামাজনের প্রভাবতো ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে। এমনিতেই গত একশ’ বছরে পৃথিবী গতরের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনি হারে তাপমাত্রা বাড়ায় নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়তে হচ্ছে বিশ্বমানুষকে।

বিজ্ঞানীরা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, ‘উন্নয়ন, গাছপালা কেটে ফেলা, শিল্প-কারখানার দূষণ ও নগরায়নের ফলে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিদিনই বাড়ছে আবহাওয়ার বৈরিতা।’ তারা বলছেন, ‘আগামী দিনের পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকতে পারবে কী, পারবে না, এটাই এখন বড় উদ্বেগের বিষয়।’

‘কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাড়ার কারণেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে’- সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস প্রথম এই কথা বলেছিলেন সেই ১৮৯৮ সালে। তারপর বায়ুমন্ডল নিয়ে গত শতাব্দীর সত্তর দশকে কোন বিজ্ঞানী আর ততটা মাথা ঘামাননি। তবে শতাব্দীর শেষ ভাগে আবহাওয়ার বিস্তর পরিবর্তন শঙ্কায় ফেলেছে বিজ্ঞানীদের।

‘রিওডি জেনেরিও’র সম্মেলনের পর নীতি প্রণেতারা পরিবেশের বৈরিতা নিয়ে কিছুটা সজাগ হন। আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে জনমানুষকে স্পষ্ট ধারণা দিতে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচী (ইউএনইপি) এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ এবং সম্ভাব্য প্রতিবিধানের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গঠন করে আন্ত:মহাদেশীয় প্যানেল-আইপিসিসিআই।

আবহাওয়া পরিবর্তনের পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত পর্যবেক্ষণ করে আইপিসিসিআই সম্প্রতি যে রিপোর্ট জানিয়েছে, ‘মানুষসৃষ্ট সমস্যাই পৃথিবীর উষ্ণতার জন্য দায়ী। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া, ওজন স্তর ক্ষয় এসব মানুষই তৈরি করেছে। এসব কারণে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়ার ধরণধারন।’

মানুষের বিশেষ শিল্পোন্নত দেশগুলোর ধনাঢ্য মানুষগুলোর বিলাসির যাপিত জীবনে ব্যবহৃত নানা উপকরণে নির্গত হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, সিএফসি বা ক্লোরোফ্লোরোকার্বন, হ্যালন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ক্লোরোফর্মের মত প্রতিবেশবিরুদ্ধ সব গ্যাসীয় পদার্থ।

এছাড়া জীবাশ্মকে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়ে তা থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড। গাছ এই বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু বনজঙ্গল ধ্বংস করে ফেলায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া আরও স্পষ্ট হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমআয়তনের রেইনফরেস্ট ধ্বংস করছি আমরা।

অন্যদিকে কৃষি ও শিল্পে আধুনিকায়নের ফলে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড বেশি পরিমাণে নির্গত হচ্ছে। এর ফলে তাপ আটকে থাকছে বায়ুমন্ডলে। প্রতিনিয়ত বায়ুমন্ডলে জমছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস। এধরণের মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস মজুদ হয়ে গ্রিনহাউস প্রভাব বাড়াচ্ছে।

বায়ুমন্ডলের বাইরের দিকে যে ওজন গ্যাসের আবরণ রয়েছে, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা সিএফসি এবং অন্যান্য গ্যাস তা ক্রমেই ক্ষয় করে দিচ্ছে। আগে যেভাবে পৃথিবীতে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির আগমন বাঁধাগ্রস্ত হতো, ওজন স্তরের ক্ষয়ের ফলে এখন তার প্রবেশ, সেইমাত্রায় আটকে যেতে পারে না।

সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আতঙ্কিত বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, ‘আগামী দিনে বিশ্বের পরিবেশের ওপর বায়ুমন্ডলের এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। আগামী পাঁচ দশকে বিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি থেকে ৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে।’

এভাবে বায়ুমন্ডলের যত দ্রুত পরিবর্তন ঘটবে, ক্ষতিও বাড়বে তত দ্রুত। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা ১৫ থেকে ৯৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে। দেখা দেবে নানা ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পাল্টে যাবে বন, মরু, ও চারণক্ষেত্র সমূহের প্রতিবেশ পদ্ধতি। আবহাওয়া হয়ে উঠবে আরও শুষ্ক, আরও উত্তপ্ত আরও অসহনীয়, কিংবা আরও কঠিন শীতল থেকে শীতলতর বরফ। এর ফলে বিলুপ্ত হবে বিশেষ বিশেষ প্রজাতির জীব। মানব সমাজও নতুন নতুন রোগব্যাধি, ঝুঁকি ও দুর্যোগের সন্মুখীন হবে।

অবশ্য বর্তমান বিশ্বে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বার সম্ভাবনা না থাকলেও কোন কোন অঞ্চল খাদ্য ঘাটতির শিকার হতে পারে। বাস্পীভবনের ধরন পরিবর্তনের ফলে জলজ সস্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে সাগরের উত্তাপ বাড়ার কারণে ভৌত অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আবহাওয়া পরিবর্তনের এমনসব বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়বে গরীব মানুষ। বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের উপাত্ত থেকে অনুমান করা যায়, চলতি দশকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন আরও বাড়বে।

জলবায়ুর এমন পাল্টে যাওয়ার রাশ টেনে ধরতে না পারলে সবথেকে বেশী ক্ষতিতে পড়বে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো।

উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভস্থ গভীর নলকূপের পানিই এখন একমাত্র পানীয়জলের উৎস। কিন্তু এই পানি অতিরিক্ত উত্তোলনে প্রকৃতিতে প্রচন্ড ঝুঁকি আসছে। অন্যদিকে আবহাওয়ার বৈরিতার ফলে গলে যাচ্ছে পর্বত শিখরের বরফ আর মেরু অঞ্চলের হিমবাহ। ফলে সমুদ্রের পানির স্তর আরও উপরে উঠে আসছে। একসময় সমুদ্রের লোনাপানি প্লাবিত করবে ফসলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে জনজীবনে।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চরম আবহাওয়ার প্রভাব প্রসঙ্গে জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৯৪৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। চীনের ক্ষতি হয়েছে ৪৯২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, জাপানের ৩৭৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আর প্রতিবেশী দেশ ভারতের ক্ষতি হয়েছে ৭৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। গত ২০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বের সরাসরি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৯০৮ বিলিয়ন ডলার। যা মোট ক্ষতির ৭৭ শতাংশ।

আবহাওয়ার এই বৈরিতা প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। তাপমাত্রা বাড়ায় মেরুদেশের বরফ গলে যাচ্ছে। বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। এছাড়া প্রতিবছর অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানানও প্রাকৃতিক দূর্যোগের বিষয়গুলো তো রয়েছেই।

তবে পরিস্থিতি সামাল দিকে নানানও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা। খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে নিম্নমাত্রার কার্বন ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি নিরূপণে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ পেয়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশেরও বেশি সংগ্রহ করা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। এই পরিকল্পনার বড় ধরনের সাফল্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা। যে কারণে উপকূলীয় এলাকার মানুষ এখন দুর্যোগের আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ ও সময় পাচ্ছে।

সমুদ্র স্তর বৃদ্ধির কারণে এদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যেখানে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেখানে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আরো বড় ধরনের উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। আবহাওয়ার বৈরিতার সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের জন্য আর্থ-সামাজিক নানান ক্ষেত্রে টেকসই সবুজ প্রবৃদ্ধি তথা প্রাকৃতিক ব্যবস্থা অবলম্বন করা এখন সময়ের দাবি।

মনে রাখা দরকার, আবহাওয়ার বৈরিতার অনভিপ্রেত অবস্থা মোকাবেলায় সর্বক্ষেত্রে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।

লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 e=mail :   xposure7@gmail.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন