|| সারাবেলা প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ ||
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় নির্বিচারে ভরাট করা হচ্ছে স্থানীয়দের তিনফসলী জমি, খাল-বিল ও খাসসম্পত্তি। স্থানীয়দের অভিযোগ থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড বালুতে ভরাট করছে এসব জমি। জমি ছাড়াও ইতোমধ্যেই বালুতে ভরাট করা হয়েছে এলাকার দুইশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহি দুটি খাল।
স্থানীয়রা জানান, জবরদখল করে নেওয়া এসব জমি গুলোতে আলু, ধান, গম, ভুট্টা, পাটসহ সব ধরনের শাক-সবজি চাষ করা হতো। দু’চোখ যত দূর যেতো, ততদূর শাক- সবজি নজরে পড়তো। খালের পানি দিয়ে বছরজুড়ে ফসলি জমির সেচের চাহিদা পূরণ করতো কৃষকরা। এছাড়াও দখল করা ওই খালে মাছ ধরে সংসার চালাতেন স্থানীয় জেলে পরিবার। জমিখেকো থ্রি এঙ্গেল মেরিনের এমন অবৈধতা ও দস্যূতায় এখন সবটাই অতীত।
এবছর করোনা মহামারি এবং বর্ষার সময় যখন সবাই গৃহবন্দি, সেই সুযোগে থ্রি এঙ্গেল ১৫ থেকে ২০টি ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাট করে দখলে নিয়ছে এসব জমি ও খাল। বালু ভরাটে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও ওই কোম্পানির পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে লাঠি-সোটার ভয় দেখায়। জীবনের ভয়ে সবাই চুপ হয়ে যায়।
গজারিয়া উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের নয়ানগর মৌজার মেঘনা নদীর তীরে ২০০৮ সালে কিছু জমি কেনে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডে। সেই জমিতে গড়ে তোলে জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থ্রি এঙ্গেল শিপইয়ার্ড। প্রথমে স্থানীয়রা আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে কোম্পানির এই কার্যক্রমকে স্বাগত জানায়।বছর চারেক না যেতেই ২০১২-১৩ সালে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় থ্রি এঙ্গেল মেরিনের আসল চেহারা। শুরু জমি জবর দখল করে তাতে বালু ফেলে ভরাটের অপতৎপরতা।
থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেড তাদের অফিসের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভূমিহীনদের প্রায় ১৯ একর, উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে ব্যক্তি মালিকানধীন ৫১ একর তিন ফসলি জমি এবং প্রতিষ্ঠানটির পূর্ব দিকের দুইশ’ বছরের পুরনো কুমুরিয়া ও বড়চক খাল দখলে নিয়ে বালু ভরাট করে ফেলেছে। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈধ ও অবৈধ ভাবে ৪৪ একর জমি নিজেদের নামে মিউটেশন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, আমি নিজে ওই এলাকায় গিয়েছি। থ্রি এঙ্গেল যতটুকু জমি কিনেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি বালু ভরাট করেছে। ব্যক্তিগত ও সরকারি জমি এবং খালসহ যতটুকু অবৈধভাবে ভরাট করা হয়েছে তার শতভাগ উদ্ধার করা হবে। অন্যায়ভাবে যে কাজ থ্রি এঙ্গেল করেছে, তার বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের পরিচালক লোকমান হোসেনের দাবি ওই মৌজায় তাদের ৮৮ একর জমি রয়েছে। ইতোমধ্যে ৬০ একর জমি তারা কিনে নিয়েছেন। তারা কারো জমি দখল করেননি। কিছু জমি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে যা কেনার প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের কাছে অনেকে জমি বিক্রি করতে এসেছেন। অনেকের কাগজ-পত্র ঠিক নেই। আমরা তাদের কাছ থেকে জমি না কেনায় তারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করছে।
খালের বিষয়ে লোকমান হোসেন বলেন, ম্যাপে দুটি খাল থাকলেও কাগজে নেই। তবে তিনি আরো বলেন, একটি বড় প্রতিষ্ঠান করতে গেলে ব্যক্তি মালিকানা, সরকারি সব ধরনের জমি লাগে।এসব কিছুর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় এবং জেলা প্রশাসকের বরাবর লিখিত আবেদন করা হয়েছে।
স¤প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের নয়ানগর মৌজার মেঘনার তীরে গড়ে তোলা থ্রি এঙ্গেল মেরিন লিমিটেডের শিপইয়ার্ড কোম্পানিতে জাহাজ মেরামতের কাজ করছে শ্রমিকরা। এছাড়া কোম্পানির একটি পাঁচতলা ভবন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী, দক্ষিণ দিকে ফুলদি নদী এবং উত্তরে বালুরচর গ্রাম। চোখ যত দূর যায় সবটাই বালু দিয়ে ভরাট করা। বালুর মধ্যে চাপা পড়ে আছে আমন ধান।
ভুক্তভোগী আরাফাত সরকার বলেন, ২০১১ সালের ২৮শে ফেব্রæয়ারি আমাদের ১ দশমিক ৯ একর জমি ভুয়া নাম ব্যবহার করে তাদের নামে খারিজ করে নিয়েছে থ্রী এঙ্গেল মেরিন। পরে আমরা জমির খাজনা দিতে গেলে জানতে পারি জমি আমাদের নামে নেই। এসময় ভূমি অফিসে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে পুনরায় আমাদের নামে আনি। তবে এ বছর ওই জমির সাথে আমাদের আরো ৭ বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করে বালু ভরাট করেছে থ্রি এঙ্গেল। প্রতিবাদ করা চেষ্টা করেছি। বেশি করলে জীবনটাও হারাতে হবে। তাই আল্লাহর দিকে চেয়ে আছি।
আরেক ভূক্তভোগি আক্তার হোসেন বলেন, কৃষি কাজ করেই আমার সংসার চলে। নয়নগর মৌজায় আমাদের ১৬৮ শতাংশ পৈত্রিক জমি ছিল। জমির চার পাশে বড় বড় সীমানা পিলার ছিল। রাতের আধারে পিলার ভেঙ্গে বালু ভরাট করে নিয়েছে থ্রি এঙ্গেল। এতে কষ্টে ফলানো আমন ধানও বালু চাপায় পড়েছে। বালুভরাট করায় আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে অসহায় অবস্থায় আছি। প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোনও সুরাহা পাচ্ছিনা।
ভূমিহীন আব্দুল আজিজ বলেন, ২০১৫ সালে সরকার ভূমিহীনদের ২০ শতাংশ করে ফসলি জমি দেয়। সরকার থেকে পাওয়া ওই ২০ শতাংশ জমিতে আমি চাষাবাদ করতাম ২০১৯ সালেও। অথচ এ বছর দুই দফা জোর করে আমাদের জমি ভরাট করে নিয়েছে থ্রি এঙ্গেল। ভূমি অফিস, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিষয়টি জানানো হলেও তাদের কাছ থেকে কোন প্রতিকার মেলেনি।
মনিরুল হক নামে আরো একজন বলেন, ২০০৪ সালে তার মা সূর্যবান বিবি মারা যান। ২০১১ সালে আমার মায়ের সই জাল করে ৩৭ শতাংশ জমি দখলে নিয়েছে। মনিরুল বলছেন, ভুয়া নাম ব্যবহার করে আরো অনেকের জমি এমন করে দখল করেছে থ্রি এঙ্গেল। প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে জমি দখল করে নিচ্ছে ভূমি দস্যু কোম্পানি থ্রি এঙ্গেল।
তিন ফসলি জমি রক্ষা আন্দলোনের সদস্য সচিব আতাউর রহমান বলেন, ভুয়া দলিল তৈরি করার পাশাপাশি অর্পিত জমি, খাস জমি, খাল-নদী এবং ভূমিহীনদের জমি জবর দখল করে বালু ভরাট করে নিয়েছে থ্রি এঙ্গেল। ২০১৯ সালের মে মাসে প্রাক্তন জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা থ্রি এঙ্গেল কোম্পানির কাছ থেকে অবৈধ খাল-জমি উদ্ধারের নির্দেশ দেন গজারিয়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা হাসান সাদিকে। এর কিছু দিন পরেই বদলি হয়ে যান জেলা প্রশাসক। আদেশটি লুকিয়ে রাখেন উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা। আমরা সেটি পরে জানতে পারি।
এবারও জমি উদ্ধার করার জন্য বর্তমান জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারক লিপি দেওয়া হয়েছে। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) কাছে জেলা প্রশাসকের অনুলিপি নিয়ে গেলে তারা আমাদের এক প্রকার বের করে দেন। ইউএনও সাফ জানিয়ে দেন, ব্যক্তিমালিকানার জমি দেখার দায়-দায়িত্ব তাদের না। আমরা দিশেহারা হয়ে আন্দোলন ও বিক্ষোভ করেছি। কিন্তু এখনো প্রশাসন আমাদের জমি উদ্ধারে কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি।
গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাসান সাদি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কারো জমি ভরাট হয়ে থাকলে আমাদের জানালে আমরা ব্যবস্থা নেবো।