|| সারাবেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ ||
করোনাভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি আমাদেরকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। দাঁড় করিয়েছে অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি। অনেকে হারিয়েছেন স্বজন। অনেকের মাথার ওপর থেকে সরে গেছে বটবৃক্ষের মতো অভিভাবকের ছায়া। দেশের উত্তরের জেলা নওগাঁও এর বাইরে নয়।
প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ইতোমধ্যেই এই জেলায় মারা গেছেন অনেক মানুষ। অনেক পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটি। যে বটবৃক্ষের ছায়ায় ঘরের সবাই নিশ্চিন্তে, নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারতো। তাকে হারিয়ে আজ স্বজনরা হয়ে পড়েছেন অসহায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার রীতিমতো মানবেতর জীবনযাপন করছে। হঠাৎ করে যেন তুমুল ঝড় সাজানো সংসারের সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। এই অন্ধকার সরে কবে আবার কবে আলোর দেখা মিলবে তা তাদের অজানা।
কেবল স্বজনকে হারানোর আক্ষেপই নয়। প্রিয় স্বজনকে শেষ বিদায়ের সময় বুকে জড়িয়ে কাঁদতে পারেননি তারা। শুধু দূর থেকে বুকফাটা আর্তনাদ করতে হয়েছে।
ঈদুল ফিতরের সময় দোকানের মালামাল কিনতে রাজধানীতে গিয়েছিলেন নওগাঁর কাপড় ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম নুরু (৫৩)। লকডাউনের সময় সীমিত পরিসরে দোকান খুলে কয়েকদিন বেচাকেনাও করেছিলেন তিনি। এরইমধ্যে হঠাৎ অসুস্থতা বোধ করায় করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। রিপোর্ট পজিটিভ আসার একদিন পরই গত ১লা জুন তিনি মারা যান। স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়িক সুনামের পাশাপাশি ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন নুরুল।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2020/12/Naogaon-02-300x167.jpg?resize=839%2C467&ssl=1)
নুরুলের স্ত্রী ফারহানা ইসলাম মায়া বলেন, ‘আমাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। বছরের শুরুতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এরপরই শুরু হয় করোনাভাইরাস সংক্রমণ। মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাও করতে পারিনি। স্বামী ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর কর্মচারীদের নিয়ে সংসারের পাশাপাশি ব্যবসা সামলাতে হচ্ছে। দোকানে অনেক ঋণ হয়ে আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর এক দেবর অনেক সহযোগিতা করেছে। হঠাৎ করে তার মৃত্যুতে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। অভাব না থাকলেও স্বামীর অনুপস্থিতির ধকল সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মনের দিক থেকে ভেঙে পড়েছি। হাল ধরার মতো কেউ নাই। মাথার ওপর ছাদ না থাকলে যেমনটা হয়।’
করোনায় প্রাণ হারানো শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনুকূলের ভাগ্নে মিঠুন কুমার বলেন, ‘শহরের কাজীর মোড়ে মামার ছোট একটা ওষুধের দোকান ছিল। পাশাপাশি দুটি পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করতেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ করেই তার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে দুদিন পর মামা মারা যান। একমাত্র ছেলেকে তিনি পাবনার একটি কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি।’
করোনাভাইরাসে মারা গেছেন শহরের পার-নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা ডা. রতন কুমার দাস। রতন কুমারের স্ত্রী মঞ্জু জানান, ‘এই মহামারির মধ্যেও তিনি রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। সেবা দিতে গিয়ে কখন যে নিজেও সংক্রমিত হয়েছেন তা আমরা কেউ জানি না। হঠাৎ করেই সর্দি, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এরপর পরীক্ষা করালে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। গত ৯ই জুলাই তিনি মারা যান। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি।’
এই নারী জানান, স্বামীর মৃত্যুতে সংসারে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। এক ছেলেকে নিয়ে অসহায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন মনজুর-এ মুর্শেদ বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করতে আমরা আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছি। এরইমধ্যে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে সকল দোকানপাট সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে বন্ধ করা এবং সকলকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়া মানুষ যেন অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাঘুরি না করে সেজন্যও বলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সিলিন্ডারের বরাদ্দ পাঠানো হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসক ও নার্সের কোনো ঘাটতি নেই। আমাদের যা আছে তা দিয়ে করোনা মোকাবেলা করা সম্ভব।’
জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যানুযায়ী, ‘জেলায় এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২৪ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১ হাজার ৩৫৯ জন। বর্তমানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৪৭০ জন। মৃতদের মধ্যে দেড় মাসের একটি শিশু, ৪০ বছরের ২ জন, ৫০ বছরের ৮ জন, ৬০ বছরের ৫ জন এবং ৭০ বছরের ৮ জন।’