|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে মোট এক হাজার ১৩৯ জন মানুষ মারা গেছেন। এদের মধ্যে ৩৫ জন চিকিৎসক। নার্স ৩জন আর পুলিশ মারা গেছেন ১৯ জন। এরা সবাই করোনাযুদ্ধে সামনের সারির যোদ্ধা। বিশ্বপ্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মৃতের হার ১ দশমিক ৩৫ হলেও চিকিৎসকের সংখ্যায় এই হার ২ দশমিক ৯৯।
ভারতে ৯ হাজার ১৯৫ জন মারা গেলেও এদের মধ্যে কোন চিকিৎসক নেই। তবে দেশটিতে স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন ৩৪ জন।
পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৫৫১ জন মারা গেছেন। কোন চিকিৎসক মারা না গেলেও দেশটিতে স্বাস্থকর্মী মারা গেছেন ৩৭ জন।

নেপালে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১৮ জন। এদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় জড়িত কেউ না থাকলেও এখন পর্যন্ত তিনজন চিকিৎসক, সাতজন স্টাফনার্সসহ ১৪জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ মারা যান গেল ১৫ই এপ্রিল। তিনি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সহকারি অধ্যাপক ছিলেন।
করোনাযুদ্ধে সামনের সারির এই যোদ্ধাকে উন্নত চিকিৎসা দিতে সিলেট থেকে ঢাকায় আনার সামর্থ্য হয়নি রাষ্ট্রের।
করোনা সংক্রমণ এবং সম্পর্কিত উপসর্গ নিয়ে এখন পর্যন্ত যে ৩৫ জন চিকিৎসক মারা গেছেন তাদের মধ্যে গেল ১২ই জুন মারা একদিনেই মারা গেছেন ৪ জন। আর বাকি ২০ জন মারা গেছেন গত ১৩ দিনে। মৃতের হারের দিক থেকে এই সংখ্যা ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
পরিসংখ্যাণ বলছে, এখন পর্যন্ত ১১৭২ জন চিকিৎসক প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে কাজে ফিরেছেন সাড়ে ৫শ’জন। চিকিৎসক ছাড়াও ১১২০ জন নার্স ও ২শ’ জন টেকনোলজিস্ট আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন তিনজন নার্স।
ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস এন্ড রেসপন্সিবিলিটি’র তথ্য মতে ৩৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে ২৯ জন কোভিড-১৯ এ আর বাকি ৬জন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।
শনিবার সকাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছে ৮৪ হাজার ৩৭৯ জন। মারা গেছেন ১১৩৯ জন। আর সংক্রমণসংখ্যা বিবেচনায় মৃতের হার ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
করোনাযুদ্ধে সামনের সারির আরেক যোদ্ধা পুলিশ আক্রান্ত হয়েছেন এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ২০৬ জন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ১৯ জন। সংক্রমণসংখ্যা বিবেচনায় মৃতের হার দশমিক ৩১ শতাংশ।
স্বাস্থ্যকর্মীরা সংক্রমিত হচ্ছেন যেসব কারণে
করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে সংশ্লিষ্ট বিষেশজ্ঞরা বলেছিলেন, স্বাস্থ্যসুশ্রষাকর্মীদের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) না থাকা এবং যাও বা দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর মান ভাল না হওয়ায় তারা সংক্রমণঝুঁকিতে পড়েছেন।
কিন্তু এখন সেসব খামতি না থাকলেও নতুন করে যেসব বিষয় স্বাস্থ্যসুশ্রষাকর্মীদেরকে ঝুঁকিতে ফেলছে তা হচ্ছে, সঠিকভাবে পিপিই এবং নন-ডিসপোজাল পিপিই পরতে এবং খুলতে না পারা, নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) নেগেটিভ এয়ার প্রেশারের ঘাটতি।



এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী জানান, সংক্রমণে চিকিৎসকরা মারা যাচ্ছেন প্রধানত তিনটি কারণে।
প্রথমত যে সব চিকিৎসক মারা যাচ্ছেন তাদের ২৫ শতাংশেরই বয়স ৬০ এর উপরে। যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে। কো-মরবিডিটি নিয়ে যখন কাজে যাচ্ছেন তখন সহজেই তারা সংক্রমিত হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত এ্যানেস্থেশিওলজিস্টদের মধ্যে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বেশীর ভাগই আইসিইউতে রোগীকে ভেন্টিলেটর সংযোজন করতে গিয়ে সংক্রমিত হচ্ছেন।
এবং তৃতীয়ত আইসিইউতে ভেন্টিলেটর লাগাতে গিয়ে চিকিৎসকদেরকে রোগীর খুব কাছে যেতে হচ্ছে। এছাড়া দেশের বেশীর ভাগ আইসিইউতে বাতাসের চাপ নেগেটিভ রাখার সুবিধা নেই। যে কারণে আইসিইউতে কাজ করিয়ে চিকিৎসকদের বেশীর ভাগ সংক্রমিত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন।
তবে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যসুশ্রষাকর্মীদের সংক্রমণ ও মারা যাওয়ার জন্য কমিউনিটি ট্রান্সমিশনকেই দায়ী করছেন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস এন্ড রেসপন্সিবিলিটি’র যুগ্ম সম্পাদক ডা. রাহাত আনওয়ার।
একইসঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঠিক পরিকল্পনা না থাকাকেও দুষলেন তিনি। বললেন, “করোনা মোকাবেলায় দেশের যে পরিমাণ স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন তাদের বিভাজনটা সঠিক হচ্ছে না। বেশী বয়সী চিকিৎসকদেরকের, যাদের কো মরবিডিটি রয়েছে তাদেরকে সরাসরি কোভিড রোগীর চিকিৎসায় পাঠানো হচ্ছে।



এক্ষেত্রে উচিত হচ্ছে, পরিকল্পনামত রোগীর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থেকে চিকিৎসা দিতে হবে এমন ক্ষেত্রে জুনিয়র চিকিৎসকদেরকে নিয়োজিত করা। অন্যদিকে সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে আসতে হয় না এমন ক্ষেত্রে বয়স্ক ও সিনিয়রদেরকে নিয়োজিত করার পরামর্শ দেন তিনি।
চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার উদ্বিগ্ন হওয়ার মত
চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার উদ্বিগ্ন হওয়ার মত কারণ হয়ে উঠেছে। ইতালীসহ অন্য অনেকে দেশে যেখানে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশী। সেখানে আরো বেশী চিকিৎসক মারা যেতে পারতো। কিন্তু তারা সঠিক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ না থাকায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মৃতের মোট সংখ্যা বিবেচনায় প্রায় তিন শতাংশ চিকিৎসককে প্রাণ দিতে হয়েছে। যা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের থেকে অনেক বেশী।
একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়ে উঠতে ৩০ থেকে ৩৫ বছর সময় লাগে জানিয়ে ডা. রাহাত বলেন, এমনিতেই দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসুশ্রষাকর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলানয় খুবই কম। সেখানে এমনিভাবে মারা যেতে থাকলে এই ক্ষতি দেশ কাটিয়ে উঠতে পারবে না।
চিকিৎসকদের চিকিৎসায় আলাদা হাসপাতাল জরুরি



সংক্রমিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসুশ্রষাকর্মীরা সময়মত হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। পাচ্ছেন না আইসিইউ। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এমনি পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরাও মনোবল হারিয়ে ফেলছেন জানিয়ে ডা. রাহাত বলছেন, চিকিৎসকদের মত সামনের সারির যোদ্ধাদের চিকিৎসায় এই মুহূর্তে একটি আলাদা হাসপাতাল জরুরি হয়ে পড়েছে। আর সেটা যদি করা যায়, তাহলে তারা অন্তত এটুকু নিশ্চিত হতে পারবে যে, সংক্রমিত হলে তাদের সঠিক চিকিৎসাটা হবে।
করোনাভাইরাস সম্পর্কিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটিও বলেছে, সাধারণ মানুষের চিকিৎসাকে নির্বিঘ্ন করতে হলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। কমিটি ইতোমধ্যেই উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামসমৃদ্ধ একটি আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি সুপারিশ করেছে।