|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
আজকের দিনটি বিশ্বজুড়ে ভ্যালেন্টাইন’স ডে হিসাবে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব সবিশেষ।১৯৮৩ সালের আজকের দিনেই সেসময়ের সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, সময়ের পরিক্রমায় যেটি রূপ নেয় গণআন্দোলনে। সেনা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর নতুন একটি শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। এই নীতি ঘোষণার পর থেকেই প্রতিবাদ-আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। ১৭ই সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো।
আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালে ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যাবার সময় পুলিশ গুলি চালায়। এতে নিহত হন জয়নাল ও দীপালি সাহা সহ অন্তত ১০জন। দিনটি হয়ে ওঠে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে একটি চরম মুহূর্ত।’
ছাত্রসমাজের দাবি ছিল একটি অবৈতনিক বৈষম্যহীন শিক্ষানীতি। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান যে নীতি ঘোষণা করেন, সেখানে বাণিজ্যিকীকরণ আর ধর্মীয় প্রতিফলন ঘটেছে বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাই শুরু থেকেই ওই নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। বিরোধিতার প্লাটফরম থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রদের জমায়েত হবার কথা। সেখান থেকে শিক্ষানীতি প্রত্যাহারের দাবিতে স্মারকলিপি নিয়ে শিক্ষা ভবনে যাওয়া হবে। সকাল ১০টায় বটতলা থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষাভবনের দিকে এগিয়ে যান ছাত্ররা। মিছিলটি কার্জন হল আর শিশু একাডেমীর মাঝখানের রাস্তায় পৌঁছলে এ্যাকশন শুরু করে পুলিশ। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, সেখানে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। ছাত্ররা দৌড়ে কার্জন হলে ঢুকে যায় ওখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা অবস্থান নেয় শিক্ষার্থিরা। বিকালের দিকে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে শিক্ষার্থিরা ফের কলাভবন চত্তরে চলে আসে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল।
পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থিসহ অনেকের নিহত হওয়ার খবরে গোটা রাজধানীর পরিস্থিতি থমথমে হয়ে পড়ে।এরইমধ্যে শিক্ষার্থিরা আবারো বটতলায় জমায়েত হয়। সেখানেই ট্রাকে করে আনা হয় জয়নালের মৃতদেহ। বটতলার জমায়েতে এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বক্তৃতা করেন ডাকসুর ভিপি আখতারুজ্জামান। এমন সময় শিক্ষার্থিদের হঠাতে রাস্তায় নামে নতুন আনা রায়ট কার। আন্দোলনকারীদের যাতে সহজেই চেনা যায় সেজন্য রায়ট কার থেকে ছিটানো হতে থাকে রঙিন পানি।
সাবেক ছাত্রনেতা ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মোশতাক হোসেন সংবাদ মাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ”আমরা দেখেছি অনেক মৃতদেহ পুলিশ ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু জয়নাল নামের একজন ছাত্রকে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সেই মৃতদেহ বটতলায় নিয়ে এসে আমরা বিক্ষোভ করি। সেদিন পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫০জন নিহত হয়েছিল বলে আমরা ধারণা করি। কিন্তু দুজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাকি মৃতদেহগুলো গুম করে ফেলে। তাদের স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে স্বজনদের কোন খোঁজ আর পাননি।”
তবে সেদিন ঠিক কতজন খুন হয়েছিলেন সে সম্পর্কে আজো পর্যন্ত সরকারি কোন পরিসংখ্যান জানানো হয়নি।
সেদিন থেকে এই দিনটিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসাবে বলা হয় জানিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, বিকালে এবং পরের দিনও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলে। পুলিশ অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করে। মোশতাক হোসেনকেও গ্রেফতার করা হয়।
তিনি জানান, জয়নাল ছাড়া পরে মোজাম্মেল আইয়ুব নামের আরেকজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জাফর, কাঞ্চন, দীপালি সাহা নামের একটি ছোট বাচ্চাসহ অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়, যাদের পরে আর কোন খোঁজ মেলেনি। এর কিছুদিন পরে সরকার একটি ঘোষণা দিয়ে শিক্ষানীতিটি স্থগিত করে।